সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পরিবারের নতুন সংজ্ঞায়ন!

পরিবারের সংজ্ঞাটি কি সরকার বদলে ফেলেছে? প্রশ্নটি খুবই হাস্যকর মনে হতে পারে। কেননা, পরিবারের সংজ্ঞা সরকার বা সংসদ বদলে দিলেও রক্তের বন্ধন বদলানো যায় না। কিন্তু, আইনে প্রত্যেক করদাতার স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত বলেই স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পুত্র-কন্যা, মা-বাবা এই সম্পর্কগুলো উপেক্ষার এক অদ্ভূত নির্দেশনা পাওয়া গেল আমাদের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। মঙ্গলবার সংসদে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এই অভাবনীয় যুক্তি দিয়েছেন।

আইন সংশোধনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেন, বিদ্যমান আইনের কয়েকটি ধারায় অস্পষ্টতা রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকগণ-সংক্রান্ত তিনটি ধারায় অস্পষ্টতা দূর করা না হলে ব্যাংকগুলোর গতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়। কোনো পরিবারের কেউ পৃথকভাবে ব্যবসা করলে ও নিজেই করদাতা হলে তাকে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল বলা যায় না।এই একই আইন এর আগে ২০১৩ সালেও সংশোধন করা হয় এবং তখনও সংশোধনী আইন তৈরি ও অনুমোদন করিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। সেসময়ে ব্যাংকগুলোর কথিত গতিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিচালকদের পরিচালনা পর্ষদে থাকার মেয়াদ তিনবছরের জায়গায় বাড়িয়ে একটানা ছয় বছর করা হয়েছিল। তবে, পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা দুইজনেই সীমিত রাখা হয়েছিল। এখন দুটোই বাড়ানো হলো। পরিচালকরা পর্ষদে থাকতে পারবেন একটানা নয় বছর এবং একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারবেন চারজন।

গত পাঁচবছরে ব্যাংকগুলোর গতিবৃদ্ধি যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে সেই গতি ছিল নিম্নমুখী। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি অবশ্য শুধু গতবছর ২০১৭ কে ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ব্যাংকে অপরিশোধিত ঋণ বেড়েছে, সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে, অপরিশোধিত ঋণে গুটিকয়েকের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তি খাতের ব্যাংকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকানার বদল হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া নতুন ব্যাংক কার্যকর হতে পারেনি এবং এমনকি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে এসব পর্যবেক্ষণের কোন জবাব দেননি। তিনি বরং অভিযোগ করেছেন সিপিডি বাংলাদেশকে নিচে নামাতে ব্যস্ত।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অথবা দলীয় আনুগত্যের কারণে সত্য অস্বীকার ছাড়া সিপিডির উল্লেখিত পর্যবেক্ষণের বাইরে ব্যাংকিং খাতের হালচাল নিয়ে ভিন্ন কিছু বলার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং, সেই আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধু পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তিকর ধূম্রজাল সৃষ্টির বিষয়টিতেই নজর দিতে চাই। সংসদে ব্যাংকিং আইনের সংশোধনীটি পাশ হওয়ার পর বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সাংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবার কোনো বিষয় নয়। অর্থনৈতিক দৈনিক, বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার গুণে ব্যাংক ভালো চলে। এক পরিবারের চারজন কিংবা তার বেশি সদস্য কোনো সমস্যা নয়। পরিবারের সদস্যরা স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা করেন। পিতা-পুত্র কিংবা ভাই-বোনদের ব্যবসা আলাদা। তারা পৃথকভাবে কর পরিশোধ করেন। এমনকি অনেক পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক মতাদর্শও ভিন্ন। তাহলে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবারের চারজন থাকলে সমস্যা কোথায়?অর্থমন্ত্রী এবং ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মুখপাত্রের ব্যাখ্যা কিন্তু একই। এটা অবশ্য পরিষ্কার নয় যে কার ব্যাখ্যার প্রতিধ্বনি কে করলেন। অর্থমন্ত্রী কিম্বা ব্যাংক উদ্যোক্তারা যাই বলুন না কেন পরিবারের ব্যাখ্যা বদলে আইন সংশোধনের ফলে ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বা পরিবারতন্ত্র জোরদার হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেউ নিজে করদাতা হলে তাকে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল গণ্য না করার নীতিটি রাষ্ট্রের আর কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? দেশের প্রচলিত সব আইনেই (দূর্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং দন্ডবিধি) জনসেবক ( সরকারী কর্মচারি, জনপ্রতিনিধি, ব্যাংক পরিচালক প্রমুখ) এর ক্ষেত্রে স্ত্রী, সন্তান (সৎ পুত্র-কন্যাসহ), বাবা-মা, বোন এবং যেসব ভাই তাঁর সঙ্গে বসবাস করেন এঁরা সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল হিসাবে গণ্য হন। তাঁরা ব্যাক্তিগতভাবে আলাদা আলাদা কর প্রদানকারী হলেও এই সংজ্ঞায়ন থেকে তাঁদের রেহাই বা রেয়াত নেই। অর্থমন্ত্রীর নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে তিনি নির্বাচনের সময় যে সম্পদবিবরণী হলফনামা হিসাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিয়েছেন তাতে তাঁর স্ত্রীর আয় এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণও দিতে হয়েছে। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলার ক্ষেত্রেও এরকম ভুরি ভুরি নজির পাওয়া যাবে যেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের কারো কারো নামে আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতির্পূণ সম্পদ অর্জন।  


রাজনীতিক এবং জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সংজ্ঞায় যদি পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে শুধুমাত্র ব্যাংক উদ্যোক্তারা কিভাবে এই বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন? তাকি সংবিধানসম্মত হয়? নাকি, এটি একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ? মোটামুটি এটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলে পরবর্তীতে এই নজির ব্যবহার করে সব আইনকে সঙ্গতির্পূণ করার স্বার্থে দূর্র্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং দন্ডবিধিতেও প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বদলানো হবে? স্বতন্ত্র করদাতা হিসাবে পরিবারের সদস্যদের এই স্বীকৃতিতে কিছু কিছু ভ্রষ্ট রাজনীতিকওকি কিছুটা সুবিধা পাবেন?   

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...