বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অধিকাংশই আবেগপূর্ণ, তবে দলীয় আনুগত্যের বাইরেও কিছু মন্তব্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। খালেদা জিয়া যদি আজ ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ের করা মামলাগুলোর একটিও কি সচল থাকত? হয় সেগুলো সরকারি সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার হয়ে যেত, নয়তো অভিযোগ গঠন বা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতিগত ত্রুটি বের হতো এবং হাইকোর্টে সেগুলো টিকত না। বিপরীতে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা দিয়েছিল, সেগুলো সব কি সচল হতো না? তখনো কি তাঁকে হয়রানি করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলাটিকেই বেছে নেওয়া হতো না?
আসলে যাঁরা বলতে চান যে রাজনীতিই এখানে বড় কারণ, তাঁদের বক্তব্য একেবারে নাকচ করে দেওয়া যায় না। রাজনীতিতে ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁদের জন্য সবই ঠিক, আর যত অন্যায়, সেগুলোর দায় বিরোধীদের-এই প্রথা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। ক্ষমতায় থাকলে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পছন্দ না হলে প্রধান বিচারপতিকে অপবাদ ও চাপ দিয়ে দেশছাড়া করলেও তাতে আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
খালেদা জিয়ার সাজা এবং কারাগারে যাওয়ার খবরটি যেদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেদিনেই রায়টির ওপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে কালের কণ্ঠ পত্রিকায়। রায়কে যেন প্রশ্নবিদ্ধ করা না হয়, সেই কথা বলতে গিয়ে নিবন্ধটিতে অধ্যাপক জাকির হোসেন মামলাটির রায়দানকারী বিচারকের অতীত তুলে ধরেছেন। তাঁর সাবেক সহপাঠী বিচারক ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এবং বিচারক পদে তাঁর যোগদানের সময়ে খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন-এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন যে রায়কে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করাটা অন্যায়। রায় প্রকাশের দিনেই বিচারকের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ অতীতে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
অপরাধের অভিযোগ আদালত আইন অনুসারে বিচার করবেন এবং সেই আদালতকে নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না, সেটাই প্রত্যাশিত। তবে বিচারটিকে ন্যায়বিচার বা সুবিচার হিসেবে দেখানোর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। আইনশাস্ত্র শিক্ষার সময়ে আমাদের এ কথাও শেখানো হয়েছে-‘জাস্টিস শুড নট অনলি বি ডান, বাট ইট শুড ম্যানিফেস্টলি অ্যান্ড আনডাউটেডলি বি সিন টু বি ডান।’ ১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের চিফ জাস্টিস লর্ড হিউয়ার্টের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়েই অনুসৃত হয়ে আসছে, যার মূলসার হচ্ছে বিচারকের স্বাধীনতা। বিচারক কোনোভাবে প্রভাবিত হয়েছেন (শুধু সরকার কর্তৃক নয়), এমন ধারণাই একটি রায় বাতিলের জন্য যথেষ্ট।
রাজনৈতিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি চাপা দিতে খালেদা জিয়া এবং তাঁর অনুসারীরা বিচারকাজে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ করছেন, কেউ হয়তো এমন যুক্তিও দিতে পারেন। কিন্তু বিএনপির ভাষ্যমতে, এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্য-বিবৃতিই রাজনৈতিক পক্ষপাতের সবচেয়ে বড় আলামত হিসেবে হাজির হয়েছে। ‘এতিমের টাকা মেরে খাওয়া’-এর দোষ নির্বাচনী রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের প্রচারণায় মূল্যবান পুঁজি হিসেবে কাজ করবে বলেই গোটা দশেক দুর্নীতির মামলার মধ্যে শতকোটি টাকার অভিযোগ বাদ দিয়ে সবচেয়ে কম অর্থমূল্যের মামলার বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিচার শেষ হওয়ার আগেই সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ‘এতিমের টাকা মেরে খেয়ে পার পাওয়া যাবে না’ এবং রায় হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচনী প্রচারসভায় সেই একই কথা শোনা গেছে। রায় হওয়ার আগে একাধিক মন্ত্রী জনবক্তৃতায় বলেছেন, খালেদা জিয়াকে জেলের ভাত খেতে হবে।
মামলাটির রায়ের পর এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের অভিযোগ যে শুধু খালেদা জিয়ার অনুসারীরাই এনেছেন, তা নয়। রাজনৈতিকভাবে বিএনপির চেয়ে বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে এমন একাধিক বামপন্থী দলের বিবৃতিতে তা স্পষ্ট হয়েছে। সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতারা বলেছেন, ‘আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই এবং রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে সব দুর্নীতিবাজের শাস্তি চাই।’ বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, জনসম্মতিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী শাসন, ক্ষমতার প্রবল দাপট, বিপুল লুটপাটের অভিযোগ ইত্যাদির কোনো সুরাহা না করে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অতি উৎসাহের কারণে দেশবাসীর মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে এ রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে রায়ের পরও ‘সুষ্ঠু বিচার’ নিশ্চিত করার আহ্বানেও ইঙ্গিত মেলে যে এই বিচার-প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তারা সচেতন।
রায়টি নিয়ে অনেকের মধ্যেই যে বিচার-প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব পড়ার ধারণা তৈরি হয়েছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। এমন ধারণার ভিত্তি যে শুধু এই মামলা, তেমনটি বললে বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রশ্নে সৃষ্ট বৃহত্তর সংকটকে অস্বীকার করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে আসার আইন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর দফায় দফায় (হাইকোর্ট বিভাগের রায় এবং আপিল বিভাগে আপিল নাকচ হওয়ার পর) বিচারকদের যে ভাষায় মন্ত্রী ও সাংসদেরা আক্রমণ করেছেন, তাতে বিচার বিভাগের প্রতি ক্ষমতাসীন জোটের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ই যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, এমন ধারণাও জনমনে প্রবল। কেননা, ওই রায়ের আগেও যেমন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়নি, তেমনই পদত্যাগ ও দেশান্তরি হতে বাধ্য করার পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা তদন্তের কথা শোনা যায়নি। বিচারপতি সিনহার সঙ্গে সরকারের বিরোধের আরেকটি বড় কারণ ছিল অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি, যে কারণে আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের সমস্যার জন্য ‘একজন ব্যক্তি’কেই দায়ী করে বলেছিলেন যে তাঁর সরে যাওয়ার ফলে সব সমস্যা মিটে গেছে। প্রধান বিচারপতির বিদায় পুরো বিচার বিভাগের জন্য যে বার্তা দিয়ে গেছে, তা আদালতের বিচারিক স্বাধীনতার ধারণাকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সে কথা অস্বীকারের উপায় নেই।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি সিনহার উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী আমরা জানি, আশি শতাংশ মামলাতেই সরকার একটি পক্ষ। রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনেরা যে যেকোনো উপায়ে জেতার জন্য মরিয়া, তার প্রমাণ তো অহরহই পাওয়া যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র মহড়া ও হামলায় বিরোধীদের রাস্তায় নামতে না দেওয়া কি সেই মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ নয়? আদালত তাদের সেই বিজয়ী এবং কর্তৃত্ববাদী আকাঙ্ক্ষার আওতার বাইরে থাকবেন, এমনটি ভাবার সুযোগ কই?
‘গেম অব থ্রোনস’ নামের একটি জনপ্রিয় ভিডিও গেম আছে। মুঠোফোনে খেলার উপযোগী হওয়ায় এর বিশ্বব্যাপী লক্ষণীয় প্রসার ঘটেছে। আদতে এটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অত্যন্ত জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক। লেখক জি আর মার্টিনের সর্বাধিক বিক্রীত ধারাবাহিক কল্পকাহিনি আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার-এর চিত্রায়ণ। ওয়েস্টরোস নামের এক কল্পিত মহাদেশের সেভেন কিংডমের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে মধ্যযুগের দুই ক্ষমতাধর রাজপরিবারের লড়াই এই ধারাবাহিকের কাহিনি। এতে যেমন আছে সৎ ব্যক্তির চরিত্র, তেমনই আছে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, দলত্যাগী, ভাড়াটে সৈন্য, বিত্তবান, ভূস্বামী। কৌশলগত জোট গঠন, নিষ্ঠুর প্রতিশোধ, কূটচাল সবকিছুই আছে। ভিডিও গেমটিও সেভাবেই তৈরি। প্রতিপক্ষকে হারানো ও ক্ষমতা সংহত করতে পারার এক অদ্ভুত সুখানুভূতিই এর সাফল্যের রহস্য। বাংলাদেশে অবশ্য এই ধারাবাহিক বাজার পাবে কি না সন্দেহ। গত তিন দশকের রাজনীতিতে আমরা যা দেখছি, তাতে ‘গেম অব থ্রোনস’-এর পেছনে পয়সা খরচ করলে তা হবে স্রেফ অপচয়!
(১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন