পূর্বাণী বা চিত্রালী—কোনো এক বিনোদন সাপ্তাহিকে একসময়ে ‘হাওয়া থেকে পাওয়া ‘নামে একটি কলাম ছাপা হতো। কলামটি ছিল মূলত রুপালি পর্দার আড়ালে বা সিনেমা জগতের বাইরে নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিগত জীবন ঘিরে নানা ধরনের গালগল্প বা শোনা কথার নাটকীয় বিবরণ। পাঠকদের নজর কাড়াই ছিল সেসব চটুল হাওয়াই খবরের মূল উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি খবরে আবার সেই ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’–জাতীয় কাহিনিগুলো ফিরে এসেছে। তবে এখনকার খবরের চরিত্রগুলো রুপালি পর্দার তারকা নন। ছোট পর্দায় তাঁরা সারাক্ষণই আসেন, কখনো খবর হয়ে, কখনো বির্তক করতে। তাঁরা যে একেবারে অভিনয় করেন না, তা–ও বলা যাবে না। কেননা, তাঁরা সবার সামনে যা বলেন, সব সময়ে তা যে বিশ্বাস করেন বা প্রতিপালন করেন, তা নয়। এখনকার ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ ঘটনাবলিতে তাঁদের কোনো কিছুই করতে হয় না। কারও সঙ্গে গোপন অভিসারের কোনো প্রশ্নই তো ওঠে না। কেননা, এখনকার হাওয়া থেকে পাওয়া খবরগুলো তৈরি করেন কতিপয় অতীব সৃজনশীল পুলিশ কর্তা। অবশ্য এর কৃতিত্ব যে তাঁদেরই, তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। যেসব রাজনৈতিক নেতার কাছে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়, এ ধরনের সৃজনশীলতা সেই সব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মস্তিষ্কপ্রসূতও হতে পারে।
কিছুদিন ধরেই খবর বেরুচ্ছে যে বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের নতুন করে যে ধরপাকড় চলছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে গায়েবি অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে। গায়েবি মামলা অভিধাটি স্পষ্টতই ব্যবহৃত হয়েছে এটা বোঝাতে যে মামলায় বর্ণিত অপরাধ আদতেই ঘটেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে আছেন কথিত অপরাধের বর্ণিত সময়ে জীবিত ছিলেন না এমন মৃত ব্যক্তি অথবা কথিত অঘটনের সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি হজ পালন করছিলেন (মৃত ব্যক্তিকেও ককটেল ছুড়তে দেখেছে পুলিশ, প্রথম আলো, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)। পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হুবহু প্রকাশের মতো গণসংযোগের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে যাঁরা সাংবাদিকতার ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থেকে তথ্যগুলো যাচাই করতে গিয়েছেন, তাঁদের কাছেই আসল সত্যটা ধরা পড়েছে। কিন্তু তাতেও সৃজনশীলতার বিকাশ রুদ্ধ হয়নি। অতএব, ঢাকায় ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের দিনে মগবাজারে নাশকতার মামলায় আসামি হয়েছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এবারও কথিত নাশকতার ষড়যন্ত্রকারীদের তালিকায় বিএনপির এমন নেতার নাম ঢুকেছে, যিনি ঘটনার দিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে (আমীর খসরুকে আসামি করে বিব্রত পুলিশ, আমাদের সময়, ৩ অক্টোবর, ২০১৮)।
গায়েবি মামলায় যে রাজনীতি আছে, তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। পুলিশ মামলায় লিখেছে, মগবাজারে হাঙ্গামা হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেছেন, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নাশকতার ভয়াবহ ছক আঁকছে, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই বিএনপির নেতাদের নামে মামলা হয়েছে (গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রথম আলো, ২ অক্টোবর, ২০১৮)। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, ১৯টি জেলা ও মহানগরে ৫৮টি গায়েবি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৪০ জন নেতা-কর্মীকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ জন নেতা-কর্মীকে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনের সময় তাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই এসব গায়েবি মামলার আশ্রয় নিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর সময় যে হারে বিরোধী নেতা–কর্মীদের ধরপাকড় করা হয়েছে—বিশেষত পুরোনো মামলায়, যেগুলোতে তাঁদের নাম ছিল না—তাতে দলটির আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক, সে কথা বলা যাবে না।
যাঁরা অতীত অপশাসনের জন্য বিএনপির অভিযোগকে তেমন একটা আমলে নিতে চান না, তাঁরাও যে সব সময়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। এখানে স্মরণ করা যায় যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধূরীর দুর্ভোগের কথা। প্রথম মামলায় পুলিশের নথিতে চাঁদাবাজির অভিযোগকারী যিনি, তিনি সংবাদমাধ্যমকে বললেন যে আসামিকে তিনি চেনেন না, তাঁর কোনো অভিযোগও নেই। এরপর আবিষ্কৃত হলো দ্বিতীয় আরেকটি গায়েবি মামলা—গাজীপুরে বিস্ফোরক রাখার মামলা। আদালত অবশ্য পুলিশের সেই অবিশ্বাস্য সৃজনশীলতা বিশ্বাস করেননি এবং মামলাটি খারিজ হয়েছে। মোজাম্মেল হকের ভাগ্য ভালো যে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন এবং নাগরিক অধিকারের জন্য কাজ করায় তাঁর পক্ষে সুশীল সমাজের সদস্যরা সরব ছিলেন। তবে ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশের রিমান্ড নামক যন্তর-মন্তরে তাঁকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তার জন্য পুলিশ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষতিপূরণ কিছুই দেওয়া হয়নি।
এর বিপরীত চিত্রটিও কম ভয়াবহ নয়। তথ্য সঠিক হলেও ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে তা প্রকাশের জন্য একাধিক অনলাইন পোর্টালের যেসব ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। শুধু ভিন্নমত প্রকাশের জন্য ৫৭ ধারার খড়্গের নিচে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম এখন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন, অভিযোগকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন নেতা। একই ধরনের অভিযোগ এবং কথিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বদলে তাঁর বা তাঁদের সমর্থকদের দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে সারা দেশে কতজন সম্পাদক-সাংবাদিক-গবেষককে যে পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের এই যথেচ্ছাচারে নাকাল এবং ক্ষুব্ধ পেশাজীবীদের প্রতিবাদের মুখে তা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন সরকার আরও কঠোর আইন করেছে। সরকারের যুক্তি, ‘মিথ্যা সংবাদের কারণে যার ক্ষতি হলো, সেই ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে?’ সুতরাং, মানহানি বা অপবাদ থেকে রক্ষাই এই নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লক্ষ্য।
বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ যখন কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তারের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তাকে গণমাধ্যমে অপরাধী প্রমাণের জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির করে, তখন সেই ব্যক্তির ক্ষতিটা কে পূরণ করবে, সেই প্রশ্নের অবশ্য কোনো জবাব নেই। কেননা, পুলিশ ক্ষমতাধরদের অপরাধ উপেক্ষা করে। কারণ, সেটা আমলে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু গায়েবি মামলার যথেচ্ছাচারে পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা কেউ গুরুতর অপরাধ করলেও পুলিশের ভাষ্য মানুষ বিশ্বাস না–ও করতে পারে।
সরকারসমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নতুন আইনের পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফেসবুকে দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাস যেভাবে সাইবার হয়রানির শিকার হয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রতিকারের উপায় হিসেবে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টাও তাঁরা করেছেন। লিটন দাসের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তা নিন্দনীয় অপরাধ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের বিধানেই যে এর প্রতিকার সম্ভব, সে সত্যটি তাঁরা আড়াল করছেন। ফেসবুকে গুজব বা উড়ো খবর ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ঘটনা দেশে একাধিকবার ঘটেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে হামলার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু অপরাধীদের কারও বিচার হয়নি। বিষয়টা এমন নয় যে প্রয়োজনীয় আইনের অভাবে ওই জঘন্য অপরাধের বিচার হয়নি, বরং সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলাটি অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, মন অপরাধী না হলে উদ্বেগের কিছু নেই। এতে বোঝা যায়, সরকার ও সরকারি দলের বিরুদ্ধে না লিখলে উদ্বেগের কারণ নেই। এর মানে, বিরুদ্ধে লিখলেই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকবে এবং আমরা যাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক বিধানগুলোর বিরোধিতা করছি, আমাদের মন ‘অপরাধীর মন’।
সরকারবিরোধিতাকে অপরাধ গণ্য করা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মেলে না, সেটা আওয়ামী লীগের কাছে অজানা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগই এখন সেই চর্চাকে সাইবার জগতে প্রয়োগের আইনগত বৈধতা দেওয়ার পালা সম্পন্ন করছে।
( ৬ অক্টোবর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
সম্প্রতি খবরে আবার সেই ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’–জাতীয় কাহিনিগুলো ফিরে এসেছে। তবে এখনকার খবরের চরিত্রগুলো রুপালি পর্দার তারকা নন। ছোট পর্দায় তাঁরা সারাক্ষণই আসেন, কখনো খবর হয়ে, কখনো বির্তক করতে। তাঁরা যে একেবারে অভিনয় করেন না, তা–ও বলা যাবে না। কেননা, তাঁরা সবার সামনে যা বলেন, সব সময়ে তা যে বিশ্বাস করেন বা প্রতিপালন করেন, তা নয়। এখনকার ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ ঘটনাবলিতে তাঁদের কোনো কিছুই করতে হয় না। কারও সঙ্গে গোপন অভিসারের কোনো প্রশ্নই তো ওঠে না। কেননা, এখনকার হাওয়া থেকে পাওয়া খবরগুলো তৈরি করেন কতিপয় অতীব সৃজনশীল পুলিশ কর্তা। অবশ্য এর কৃতিত্ব যে তাঁদেরই, তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। যেসব রাজনৈতিক নেতার কাছে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়, এ ধরনের সৃজনশীলতা সেই সব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মস্তিষ্কপ্রসূতও হতে পারে।
কিছুদিন ধরেই খবর বেরুচ্ছে যে বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের নতুন করে যে ধরপাকড় চলছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে গায়েবি অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে। গায়েবি মামলা অভিধাটি স্পষ্টতই ব্যবহৃত হয়েছে এটা বোঝাতে যে মামলায় বর্ণিত অপরাধ আদতেই ঘটেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে আছেন কথিত অপরাধের বর্ণিত সময়ে জীবিত ছিলেন না এমন মৃত ব্যক্তি অথবা কথিত অঘটনের সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি হজ পালন করছিলেন (মৃত ব্যক্তিকেও ককটেল ছুড়তে দেখেছে পুলিশ, প্রথম আলো, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)। পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হুবহু প্রকাশের মতো গণসংযোগের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে যাঁরা সাংবাদিকতার ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থেকে তথ্যগুলো যাচাই করতে গিয়েছেন, তাঁদের কাছেই আসল সত্যটা ধরা পড়েছে। কিন্তু তাতেও সৃজনশীলতার বিকাশ রুদ্ধ হয়নি। অতএব, ঢাকায় ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের দিনে মগবাজারে নাশকতার মামলায় আসামি হয়েছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এবারও কথিত নাশকতার ষড়যন্ত্রকারীদের তালিকায় বিএনপির এমন নেতার নাম ঢুকেছে, যিনি ঘটনার দিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে (আমীর খসরুকে আসামি করে বিব্রত পুলিশ, আমাদের সময়, ৩ অক্টোবর, ২০১৮)।
গায়েবি মামলায় যে রাজনীতি আছে, তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। পুলিশ মামলায় লিখেছে, মগবাজারে হাঙ্গামা হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেছেন, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নাশকতার ভয়াবহ ছক আঁকছে, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই বিএনপির নেতাদের নামে মামলা হয়েছে (গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রথম আলো, ২ অক্টোবর, ২০১৮)। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, ১৯টি জেলা ও মহানগরে ৫৮টি গায়েবি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৪০ জন নেতা-কর্মীকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ জন নেতা-কর্মীকে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনের সময় তাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই এসব গায়েবি মামলার আশ্রয় নিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর সময় যে হারে বিরোধী নেতা–কর্মীদের ধরপাকড় করা হয়েছে—বিশেষত পুরোনো মামলায়, যেগুলোতে তাঁদের নাম ছিল না—তাতে দলটির আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক, সে কথা বলা যাবে না।
যাঁরা অতীত অপশাসনের জন্য বিএনপির অভিযোগকে তেমন একটা আমলে নিতে চান না, তাঁরাও যে সব সময়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। এখানে স্মরণ করা যায় যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধূরীর দুর্ভোগের কথা। প্রথম মামলায় পুলিশের নথিতে চাঁদাবাজির অভিযোগকারী যিনি, তিনি সংবাদমাধ্যমকে বললেন যে আসামিকে তিনি চেনেন না, তাঁর কোনো অভিযোগও নেই। এরপর আবিষ্কৃত হলো দ্বিতীয় আরেকটি গায়েবি মামলা—গাজীপুরে বিস্ফোরক রাখার মামলা। আদালত অবশ্য পুলিশের সেই অবিশ্বাস্য সৃজনশীলতা বিশ্বাস করেননি এবং মামলাটি খারিজ হয়েছে। মোজাম্মেল হকের ভাগ্য ভালো যে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন এবং নাগরিক অধিকারের জন্য কাজ করায় তাঁর পক্ষে সুশীল সমাজের সদস্যরা সরব ছিলেন। তবে ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশের রিমান্ড নামক যন্তর-মন্তরে তাঁকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তার জন্য পুলিশ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষতিপূরণ কিছুই দেওয়া হয়নি।
এর বিপরীত চিত্রটিও কম ভয়াবহ নয়। তথ্য সঠিক হলেও ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে তা প্রকাশের জন্য একাধিক অনলাইন পোর্টালের যেসব ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। শুধু ভিন্নমত প্রকাশের জন্য ৫৭ ধারার খড়্গের নিচে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম এখন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন, অভিযোগকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন নেতা। একই ধরনের অভিযোগ এবং কথিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বদলে তাঁর বা তাঁদের সমর্থকদের দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে সারা দেশে কতজন সম্পাদক-সাংবাদিক-গবেষককে যে পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের এই যথেচ্ছাচারে নাকাল এবং ক্ষুব্ধ পেশাজীবীদের প্রতিবাদের মুখে তা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন সরকার আরও কঠোর আইন করেছে। সরকারের যুক্তি, ‘মিথ্যা সংবাদের কারণে যার ক্ষতি হলো, সেই ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে?’ সুতরাং, মানহানি বা অপবাদ থেকে রক্ষাই এই নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লক্ষ্য।
বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ যখন কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তারের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তাকে গণমাধ্যমে অপরাধী প্রমাণের জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির করে, তখন সেই ব্যক্তির ক্ষতিটা কে পূরণ করবে, সেই প্রশ্নের অবশ্য কোনো জবাব নেই। কেননা, পুলিশ ক্ষমতাধরদের অপরাধ উপেক্ষা করে। কারণ, সেটা আমলে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু গায়েবি মামলার যথেচ্ছাচারে পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা কেউ গুরুতর অপরাধ করলেও পুলিশের ভাষ্য মানুষ বিশ্বাস না–ও করতে পারে।
সরকারসমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নতুন আইনের পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফেসবুকে দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাস যেভাবে সাইবার হয়রানির শিকার হয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রতিকারের উপায় হিসেবে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টাও তাঁরা করেছেন। লিটন দাসের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তা নিন্দনীয় অপরাধ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের বিধানেই যে এর প্রতিকার সম্ভব, সে সত্যটি তাঁরা আড়াল করছেন। ফেসবুকে গুজব বা উড়ো খবর ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ঘটনা দেশে একাধিকবার ঘটেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে হামলার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু অপরাধীদের কারও বিচার হয়নি। বিষয়টা এমন নয় যে প্রয়োজনীয় আইনের অভাবে ওই জঘন্য অপরাধের বিচার হয়নি, বরং সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলাটি অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, মন অপরাধী না হলে উদ্বেগের কিছু নেই। এতে বোঝা যায়, সরকার ও সরকারি দলের বিরুদ্ধে না লিখলে উদ্বেগের কারণ নেই। এর মানে, বিরুদ্ধে লিখলেই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকবে এবং আমরা যাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক বিধানগুলোর বিরোধিতা করছি, আমাদের মন ‘অপরাধীর মন’।
সরকারবিরোধিতাকে অপরাধ গণ্য করা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মেলে না, সেটা আওয়ামী লীগের কাছে অজানা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগই এখন সেই চর্চাকে সাইবার জগতে প্রয়োগের আইনগত বৈধতা দেওয়ার পালা সম্পন্ন করছে।
( ৬ অক্টোবর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন