সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মন্ত্রীদের বিশ্বাসভঙ্গের প্রতিবাদ সম্পাদকদের সাহসী পদক্ষেপ


বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র শিল্পের সম্পাদকরা আবারও প্রতিবাদ জানানোয় তাঁদেরকে ধন্যবাদ। গণমাধ্যমের অন্য একটি অংশ বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকরা এবং সরকার-সমর্থক সাংবাদিক ইউনিয়ন যখন এই নির্বতনমূলক কালো আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে তখন সংবাদপত্রের সম্পাদকরা যে অবস্থান নিয়েছেন তা নিসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ।

বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর সম্পাদক পরিষদ এক সভার পর দেওয়া বিবৃতিতে তাঁদের উদ্বেগের কথা মন্ত্রীসভায় উত্থাপনের বিষয়ে তিনজন মন্ত্রী তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করায় তাঁরা এটিকে আস্থা ও বিশ্বাসের লংঘন বলে অভিহিত করেছেন। বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ বলেছেন সাইবার জগত ও ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা সমর্থন করেন। কিন্তু, রাষ্ট্রপতির সই করা বিলের নয়টি বিতর্কিত ধারা মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থী, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধাত্মক।

বিবৃতিতে তাঁরা মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা শিগগিরই শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনে আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেছেন আইনটিকে বাকস্বাধীনতার প্রতি গুরুতর হুমকি বিবেচনা করে সাংবাদিক ও নাগরিক সম্প্রদায় যে উদ্বেগ জানিয়েছে, তা নিরসনের এটাই শেষ সুযোগ।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে সম্পাদক পরিষদের বৈঠকটি হয়েছে ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেনের সভাপতিত্বে এবং বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী সম্পাদকদের মধ্যে তাঁরাও আছেন যাঁদের সহযোগী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রধান নির্বাহী ও মালিকরা সরকারের অবস্থানকে মাত্র একদিন আগেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। বুধবার (১০ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো)  পক্ষ থেকে এ সমর্থন জানানো হয় বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
অ্যাটকোর বর্তমান নেতা হলেন বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান। অন্য যেসব মালিকরা বৈঠকটিতে উপস্থিতি ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মোজাম্মেল বাবু, নাজমুল হাসান পাপন, মঞ্জুরুল ইসলাম, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ প্রমুখ। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে এসব টেলিভিশন মালিকদের ঘনিষ্ঠতা এবং আনুগত্যের বিষয়টি সবারই জানা।

সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো বিবৃতি দিয়ে আইনটির বিষয়ে আগে প্রতিবাদ জানালেও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হওয়ার পর তাদের সরকার-সমর্থক অংশটি আর কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় নি। বৃহস্পতিবার এই অংশের ইউনিয়ন নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিক কল্যাণ তহবিলের জন্য কুড়ি কোটি টাকার অনুদান গ্রহণ করেছেন। এই পটভূমিতে জনমনে যদি এমন ধারণা হয় যে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি সরকারের সুনজর রয়েছে বোধকরি তাতে খুব একটা ভুল হবে না। 

ইত্যবসরে, সরকারের অপ্রিয় হিসাবে পরিচিত দেশের প্রধান দুটি সংবাদপত্র প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুটির স্বত্ত্বাধিকারী ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান লতিফুর রহমানকে দূর্নীতি দমন কমিশন জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে টাকা পাচার ও সরকারি জমি দখলে রাখার অভিযোগের জবাব দিতে আগামী ১৮ অক্টোবর কমিশনে তলব করেছে। এর আগে, ২০১৫ সালের মে মাসেও দূর্নীতি দমন কমিশন লতিফুর রহমান, তাঁর ভাই সাইফুর রহমান ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে একইধরণের অভিযোগ এনে তদন্ত করে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সেবছরেই অগাস্ট মাসে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় কমিশন তা নিষ্পত্তি করে দিয়েছিল।

এবছরেই এপ্রিল মাসে সমকাল পত্রিকার প্রকাশক ব্যবসায়ী একে আজাদকে দূর্নীতি দমন কমিশন তলব করে। সমকাল পত্রিকা এবং তাঁর মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের কিছু সংবাদের বিষয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে সমালোচনার পরই কমিশনকে কথিত দূর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তৎপর হতে দেখা যায়। তার আগে মার্চ মাসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অননুমোদিত নির্মাণের অভিযোগে মি আজাদের বাসভবনের একটি অংশ ভেঙ্গে দেয়।

গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের এধরণের বৈরি আচরণের বিরুদ্ধে শুধু সাংবাদিকরাই নয়, বৃহত্তর সমাজের সমন্বিত প্রতিবাদ প্রয়োজন। রাজনৈতিক আনুগত্য এবং স্বার্থের কারণে যাঁরা এই প্রতিবাদ থেকে গা বাঁচিয়ে চলছেন তাঁদের সুবিধাবাদিতার কাছে সবাই আত্মসমর্পণ করবেন সেটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সুতরাং, আমাদের প্রত্যাশা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সম্পাদক পরিষদ তাঁদের প্রতিবাদ জারি রাখবেন, সচেতন নাগরিকরাও রাজনীতির উর্ধে্ব উঠে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সোচ্চার হবেন।   

এবিষয়ে আরও পড়তে পারেন : https://kamalahmedbd.blogspot.com/2018/10/blog-post_9.html

মন্তব্যসমূহ

  1. বড় ভাই কী মন্তব্য করব। তবে দুদক ক্রমেই আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে

    উত্তরমুছুন
  2. বড় ভাই কী মন্তব্য করব। তবে দুদক ক্রমেই আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...