কোনো অঘটন না হলে বহুল আলোচিত সংলাপ হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। সংলাপের প্রয়োজন
কেউ অস্বীকার করতে না পারলেও এর সাফল্য নিয়ে সবার মনেই সংশয় আছে। সংশয় বললেও আসলে কম
বলা হয়। সম্ভবত: আশংকা কথাটিই এখানে বেশি প্রযোজ্য। আশংকার কারণ হচ্ছে সংলাপ সফল না
হলে উত্তেজনা বাড়বে, সংলাপে আশা পূরণ না হওয়ার হতাশা থেকে ক্ষুব্ধ যেকোনো পক্ষই আরও
কঠোর অবস্থান নিতে পারে। যার পরিণতি হবে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আরও দমনপীড়ন।
তবে, সংশয় বা আশংকা যাই থাকুক না কেন, সংলাপকে সবাই স্বাগত জানিয়েছেন। এই উদ্যোগে
রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে এমনটি আশা না করলেও এই উদ্যোগ যে সাময়িকভাবে হলেও উত্তেজনার
তাপবৃদ্ধি স্থগিত করেছে সেজন্য রাজনৈতিক বিভাজনের উভয়পক্ষকেই ধন্যবাদ। সরকারকে
ধন্যবাদ, সংলাপের অনুরোধে সাড়া দেওয়ার জন্য, আর ঐক্যফ্রন্টকে ধন্যবাদ আলোচনার জন্য
আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানোর জন্য। লিখিতভাবে আলোচনায় বসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে
চিঠি পাঠানোর ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। এর আগে, দলমতনির্বিশেষে যুগের পর যুগ রাজনীতিকরা
মাঠের বক্তৃতাতেই সংলাপ দাবি করে এসেছেন, এবং তার ভিত্তিতেই সরকারগুলো বাধ্য হলে আলোচনায়
বসেছে।
এবারের সংলাপ আয়োজনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটিও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। মাত্র ২৪ ঘন্টার
মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক জবাব। একেবারে নতুন গড়ে ওঠা একটা জোটের দাবির মুখে
এতো দ্রুততার সঙ্গে সংলাপে রাজি হওয়ার নেপথ্যে যে বিশেষ কোনো কারণ নেই, সেকথা কেউই
জোর দিয়ে বলতে পারেন না। বিশেষত: একদিন আগেই যেখানে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক
ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন যে জনগণ ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ডঃ কামালের বিচার করবে। সংবিধান
লংঘনের জন্য সরকারের বিচার হবে বলে চট্টগ্রামের জনসভায় ডঃ কামালের বক্তব্যের জবাবে
ওবায়দুল কাদেরের পাল্টা হুমকিতে উত্তেজনা বাড়ার লক্ষণই দৃশ্যমান হচ্ছিলো।
এই সম্ভাব্য সংলাপের তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
এতে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নিজেই থাকবেন। অতীতের সংলাপগুলোর স্মৃতি যদি কেউ বিস্মৃত
না হয়ে থাকেন তাহলে সবারই মনে পড়বে যে ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে সংলাপে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিত্ব
করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব, যাঁরা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য ক্ষমতায়িত
ছিলেন না। আলোচনার স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মাঝপথেই সেসব আলোচনার অনেক কথা
হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এবারের সংলাপে অন্তত সরকারের দিক থেকে সিদ্ধান্তগ্রহণে কোনো পিছুটান
থাকছে না।
তবে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জন্য এই একই কথা বলা যাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ফ্রন্টের
প্রধান হিসাবে ডঃ কামাল হোসেনকে বিদেশি কূটনীতিকরা যখন নেতৃত্বের প্রশ্ন জানতে চেয়েছিলেন
তখন তিনি যৌথ নেতৃত্বের কথা বলেছেন। যার অর্থ হচ্ছে জোটের সবার ঐকমত্যের ওপর তা নির্ভরশীল।
তাঁরা যে সাতদফায় সম্মত হয়েছেন সেসব দফার কোনটি বা কতটুকু তাঁরা ছাড় দিতে একমত হবেন
সেকথা তাঁরা সংলাপে তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারবেন এমনটি মনে করা কঠিন।
সংলাপ যে দুটি পক্ষের মধ্যে হওয়ার কথা, তার দুই প্রান্তের দুটি জোটের চিত্র
একেবারেই আলাদা। সরকারের যে মহাজোট, তাতে প্রধান দল আওয়ামী লীগ। এই জোটের নেতৃত্ব আওয়ামী
লীগের হাতে এতোটাই সংহত যে অন্য দলগুলোর অবস্থান শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যের
লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। বিপরীতে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপি, কিন্তু নেতৃত্বে
আছেন গণফোরাম প্রধান ডঃ কামাল। ডঃ কামালের গণফোরাম ছোট দল হলেও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শগত
অবস্থান একেবারেই স্বতন্ত্র। একইভাবে, স্বাতন্ত্র্য রয়েছে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যে ২০ দলীয় জোট (জামাত যার অংশ) তার চালকের আসনে ছিল বিএনপির
নেতৃত্ব। কিন্তু, নতুন ও বৃহত্তর জোটের ডঃ কামালের পক্ষে যেমন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া
সম্ভব নয় যা বিএনপি গ্রহণ করবে না, ঠিক তেমনই বিএনপির পক্ষেও এখনই তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত
পোষণ করে জোট ত্যাগ করা কঠিন। সরকার সম্ভবত: এই দূর্বলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে
আছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখন কিভাবে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে সেই প্রশ্নটাও
এখন অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে।
সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে
আমন্ত্রণ জানানোর দিনেই বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আরেকটি মামলায় সাত বছরের
কারাদন্ড হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলার শুনানি করতে কারাগারে আদালত বসানো
এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিচার সম্পন্ন করায় খালেদা
জিয়ার অনুসারীরা যে আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন কোনো সন্দেহ নেই। পরদিনই হাইকোর্টে এতিমখানার
মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা দ্বিগুণ হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সাতদফার প্রথম
দফার অংশ হওয়ায় সংলাপ প্রশ্নে বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সংশয়-শঙ্কা তৈরি হবে – এটাই স্বাভাবিক। তবে, আইনী প্রক্রিয়া যে এখনও শেষ হয়নি এবং খালেদা জিয়া প্রার্থী
না হতে পারলেও যে দলটি ভোটের আসরে দূর্বল নয় এই আত্মবিশ্বাস দলটির রয়েছে বলেই ইঙ্গিত
মেলে। যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন ‘এই রায় আমাদের পুরোপুরি স্তম্ভিত করেছে,
বিস্মিত করেছে। অস্বাভাবিক এই রায়ে সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আদালতকে ব্যবহার
করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করাই সরকারের উদ্দেশ্য‘। তিনি বলেছেন এর ফলে সংলাপ ফলপ্রসু হওয়োর বিষয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।
জনমনে সংশয় তৈরি হোক আর না হোক বিএনপির ওপর সরকার যে চাপ বজায় রাখছে এতে কোনো
সন্দেহ নেই। বিএনপিকে যে ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হচ্ছে না , সরকার তেমনটাই দেখাতে চায়। ওবায়দুল
কাদের তাই কোনোধরণের রাখ-ঢাক না করেই বলেছেন যে সরকার বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসছে না,
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বসছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপকে একটা মাঝামাঝি ব্যবস্থা বললে বোধহয় ভুল হবে
না। কেননা, এতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই মুখরক্ষা হচ্ছে। এতে যেমন শুধু আওয়ামী লীগ
ও বিএনপির সংলাপ হচ্ছে না তেমনই বিএনপিকে বাদ দিয়েও কোনো আলোচনা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর
চিঠিতে ‘সংবিধানসম্মত‘ সব বিষয়ে আলোচনার যেকথা বলা হয়েছে তাকে অনেকে একধরণের
শর্ত হিসাবে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু, সেটি যদি একটি শর্তও হয় তাতে কি আলোচনা বাধাগ্রস্ত
হতে পারে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাতদফা যদি সংবিধানসম্মত না হোত তাহলে হয়তো এই
প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিতে পারতো। কিন্তু, সংবিধানের ব্যাখ্যা সংবিধান প্রণয়ন কমিটির
প্রধান জানেন না এবং তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো সংবিধানের মধ্যে সমাধান সম্ভব নয় এমনটি
ধারণা করা অযৌক্তিক।
ঐক্যফ্রন্টের সাতদফার মূল কথা হচ্ছে এমন একটি গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, যাতে
সব নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারিত্বর্পূণ
নির্বাচন সম্ভব হয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। এই দাবিগুলো নতুন নয়। নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলনে
এসব দাবির প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য হয়েছিলো। কিন্তু, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়দলই সেই
ঐকমত্য থেকে বিচ্যূত হয়েছিল। বিএনপি এখন আবার সেই অঙ্গীকারে ফিরে আসার কথা বলেছে। কিছুদিন
আগেও আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন যে তাঁদেরকে ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য হতে পারে না। এখন
তাঁদের জন্য সুযোগ এসেছে সেই জাতীয় ঐকমত্যে ফিরে আসার। বামজোটের মত যাঁরা এই দুই জোটের
বাইরে থেকে যাচ্ছেন তাঁরাও গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার ফেরানোর এই উদ্যোগে শামিল হলে জাতীয়
ঐকমত্য আরও সুদৃঢ় হতে পারে।
অবশ্য, এই সংলাপ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের দাবি পূরণে সরকারের
আন্তরিকতা প্রকাশের কৌশল হিসাবে প্রমাণ হলে তার পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে। ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইন, সড়কের নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইন তৈরির ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে
আলোচনার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় আলামত মেলে যে লোকদেখানো আলোচনার কৌশল অনুসরণেই সরকার
বেশি আগ্রহী।
( ৩১ অক্টোবর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের বিশ্লেষণ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন