সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর আন্দোলনের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা নয়। আমাদের রাজনীতির যে রুপান্তর ঘটেছে, বিশেষ করে রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় অনভিজ্ঞদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন, ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ও দাপটকবলিত সংসদের কাজকর্ম দেখে রাজনীতির কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। এখন রাজনীতি শুধু গণভবনের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ এবং দেশে যা কিছুই হয়, সবই তাঁর নির্দেশনায়। অন্তত: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা সেরকমই বলে থাকেন। চলতি শতাব্দির গোড়ায় যে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছিল, নির্বাচনকে কালো টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাবমুক্ত করে স্বচ্ছ্ব ও সুষ্ঠূ প্রতিদ্বন্দিতামূলক করা। এই ধারণার উৎস অবশ্য নব্বুইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থান। জনগণের প্রতিনিধিত্বকে যথাসম্ভব কলুষমুক্ত করার একটা আকাঙ্খা মানুষের মধ্যে জাগ্রত করার লক্ষ্যেই এই আন্দোলন। আপাতদৃশ্যে অরাজনৈতিক ওই নাগরিক সমাজ, যাঁরা সুশীল সমাজ নামে অধিক পরিচিত, তাঁরাই এই আন্দোলনের সূচনা করেন এবং তা সংগঠিত করেন।
নব্বুইয়ের সামরিকশাসনবিরোধী গণজাগরণ থেকে উদ্ভুত হওয়ায় এর মূল লক্ষ্য
ছিল যথাসম্ভব উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। ফলে, সামরিক শাসনোত্তর রাষ্ট্রে
এক ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো বদলে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রশ্নেও জাতীয় ঐকমত্য
প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বচ্ছ্ব ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপির বিজয় দেশের
সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাছে এতোটাই আঘাত ছিল যে ইতোপূর্বেকার জাতীয়
ঐকমত্য টিকলো না। বিএনপির শাসনামলে একটিমাত্র উপনির্বাচনই নির্বাচনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে
এতোটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে যে নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি
ওঠে এবং তা তীব্র হতে থাকে। বিপরীতে আওয়ামী লীগের সরকারবিরোধীতা এতোটাই প্রবল ছিল যে
দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে, রাজনীতি গোয়ার্তুমি এবং
সংঘাতময় হয়ে ওঠে। বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন করার পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার
দাবি মেনে নেয়। রাজনীতি এরপর থেকে শুধু শক্তিমত্তার লড়াইয়ে পরিণত হয় এবং রাজনীতিতে
আবারও কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রাধান্য বিস্তার তীব্র হতে থাকে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পরই মূলত সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর নাগরিক আন্দোলন
নতুন রুপ নেয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই আন্দোলনের শুরুতে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা
পালন করে। একইভাবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সুশাসন
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে
নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ রুপকল্প ২০২১ তৈরি করে। এসব নাগরিক উদ্যোগ
ও আন্দোলনে তখন কার্যত প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।
আর, আন্দোলনের ধারণা ও বিষয়গুলো লুফে নেয় বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য
তাঁর ২০০৮ সালের নির্বাচনী সাফল্যেরর থেকে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্দোলনের
কৃতিত্বের পুরোটাই দাবি করে আসছেন। তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধ ( আগামী প্রকাশনী)। বইটির
অন্তত তিনটি নিবন্ধে ‘আমার
ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো‘ আন্দোলন তিনি কীভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কেন প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল এবং স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন
কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা বইটিতে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা তাঁর চেয়ে ভালো খুব কম
লোকই বলতে পারবেন। তাঁর বইয়ের সর্বসাম্প্রতিক সংস্করণে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেখা
একটি নিবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে ‘প্লিজ,
সাদাকে সাদা , কালোকে কালো বলুন‘।
ওই শিরোনামটি অনুসরণ করলে অবশ্য
বলতেই হয় যে নির্বাচন নামক ব্যবস্থাটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তাঁর আমলেই। তিনিই
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অনির্বাচিত সরকার এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী অভিহিত করে
সংসদীয় কমিটির সুপারিশ এবং দুই মেয়াদের জন্য জন্য ব্যবস্থাটি বহাল রাখার জন্য আদালতের
উপদেশকে নাকচ করে দিয়ে ওই ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের
পাশাপাশি আপাতদৃশ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের একটি ভালো পদ্ধতিকে অবিশ্বাস্যভাবে দলীয়
নিয়ন্ত্রণের অধীন করে ফেলেছেন। এই পদ্ধতিগত দূষণের ফল হিসাবে অবিশ্বাস্যমাত্রায় দলানুগত
দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে।
অবশ্য, এর আগেও যে কমিশনকে দলীয়করণের
চেষ্টা হয়নি, তা নয়। বিএনপি তাদের আস্থাভাজন আজিজ কমিশন গঠন করেছিল, যারা কোনো জাতীয়
নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগই পায়নি। কিন্তু, তার আগে আওয়ামী লীগ তাঁর বিশ্বস্ত দুজন
আমলা – এম
এ সাঈদের নেতৃত্বে এবং শফিউর রহমানকে নিয়ে কমিশন গঠন করে তার ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার
চেষ্টা করেছিল, যা শেষপর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে সফল হয়নি।
নির্বাচন আয়োজন ও অনুষ্ঠানে আওয়ামী
লীগের বিশ্বসযোগ্যতার সমস্যা একেবারে নতুন নয়। ১৯৭৩ এর নির্বাচন নিয়েও বিস্তর অভিযোগ
ছিল। ২০১৪‘র ৫ জানুয়ারির বিনা প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচন অনুষ্ঠানের
মাধ্যমে রকিবউদ্দিন কমিশন নতুন করে প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে দলীয় প্রভাবমুক্ত
স্বচ্ছ্ব ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। তবে, এধরণের নির্বাচন যে সরকারের রাজনৈতিক বৈধতাকে
দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেটা উপলব্ধি করেই আওয়ামী লীগ ২০১৮‘র
নির্বাচনের কৌশল বদল করে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার তাগিদ থেকে বিরোধীদের সঙ্গে
রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজন করে তাদের নানাভাবে আশ্বস্ত করে প্রতিদ্বন্দিতায় নামানো হয়। নির্বাচন
অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে এটি নিশ্চিত হওয়ার পরই বিজয় নিশ্চিত করতে রাতেরবেলায়ই ভোটের বাক্স
ভরে ফেলা হয়। ভোটারদের আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী হবে? বিনা
প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচন এবং রাতের ভোটের পর দলটি ভবিষ্যতে কীভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ
করবে? তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী বিএনপি পরপর দুবার আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে
হেরে গেছে, বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে তাদের বিভ্রান্তির ঘোর
কাটেনি। তাই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক বৈধতা দিতে ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে
তাঁরা এখনও সাজানো সংসদ ও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ তাই সহসাই তাঁদের ভোটের
অধিকার ফিরে পাবেন সেই আশা প্রায় তিরোহিত হয়েছে।
তবে, যে প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত,
তা হলো নাগরিক সমাজের যাঁরা সৎ ও যোগ্য প্রার্থী এবং কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত
নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিলেন তাঁরা কেন নীরবতা পালন করে চলেছেন? বিএনপির
প্রতি বিতৃষ্ণা তাঁদের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ বলেই অনেকের ধারণা। কিন্তু, শুধু একটি
দলের প্রতি অনাস্থার কারণে ভোটের মতো মৌলিক অধিকার জলাঞ্জলি দেওয়া কতোটা যৌক্তিক?
(shokalsondha.news পোর্টালে ৪ জানুয়ারি, ২০২০এ প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন