প্রায় পৌণে নয় কোটি অনুসারী যাঁর, যাঁর রাজনৈতিক উত্থানে টুইটারের ভূমিকা গুরুত্বর্পূণ এবং যিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রটি অংশত পরিচালনা করতেন এই সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে, তাঁকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা কোনো ছোটখাটো কথা নয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীরা এতে খুশি, কিন্তু সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। তবে, সবাই একমত তিনি তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র হারালেন।
ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবি মাইকেল কোহেনের কথায় তাঁকে অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত করা হলো। ক্ষুব্ধ ও অপমানিত ট্রাম্প নিজেই আলাদা সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম চালু করবেন বলে জানিয়েছেন।তবে, তত দিন পর্যন্ত তাঁর ‘যা ইচ্ছে তা-ই বলা‘র প্রধান পথটি বন্ধ। ২০২৪ এ আবারও নির্বাচন করার কথিত আকাঙ্খার কারণে টুইটার থেকে বিদায় তাঁর কাছে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম বেদনাদায়ক নয়, বরং বেশিও হতে পারে।
কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে টুইটারের এধরণের পদক্ষেপ এই প্রথম। টুইটার এর আগে সাময়িকভাবে ১২ ঘন্টার জন্য তাঁর অ্যাকাউন্ট স্থগিত রেখেছিল এবং সেটিও কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে প্রথম সাময়িক শাস্তি। তখনই টুইটার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিল যে সাময়িক নিষেধোজ্ঞার সময় ফুরোলে তাঁকে তাঁদের প্লাটফর্মের নীতিমালা মেনে চলতে হবে। অন্যথায় স্থায়ীভাবে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হবে। হয়েছেও তা-ই। মাত্র দুটো টুইটের জন্য এই কঠোর ব্যবস্থা। ওই দুটো টুইটে সহিংসতাকে মহিমান্বিত করার অভিযোগ করা হয়েছে।
টুইটারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে প্রথম টুইটটিতে তিনি তাঁর সাড়ে সাত কোটি ভোটারকে মহান আমেরিকান দেশপ্রেমিক অভিহিত করে তাঁদেরকে কোনোভাবেই অসম্মান বা তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। আর দ্বিতীয় টুইটে তিনি আগামী প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যাবেনা না বলে জানিয়েছিলেন।
টুইটার টুইট দুটির মূল্যায়নে বলেছে যে, এগুলো ৬ জানুয়ারি ক্যাপটিল হিলে যে অপরাধমূলক ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর পুনরাবৃত্তিতে উৎসাহ যোগাতে পারে। তাঁর সমর্থকদের আমেরিকান দেশপ্রেমিক বিশেষণে অভিহিত করা ক্যাপিটল হিলে হামলাকারীদের প্রতি সমর্থন হিসাবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। তিনি অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন না বলে জানিয়ে দেওয়ায় যাঁরা সহিংসতার পরিকল্পনা করতে পারেন তাঁরা ওই অনুষ্ঠানকে ‘নিরাপদ লক্ষ্য‘ হিসাবে গণ্য করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারের ব্যবহার এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সাবেক জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান ড্যান কোটস সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডকে বলেছিলেন যে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম প্রথম তিনি রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকতেন, টুইটারে প্রেসিডেন্ট কী ঘোষণা দেন, তা জানার জন্য। তাঁর প্রথম প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস জানিয়েছেন, ক্যানাডার অটোয়ায় ন্যাটোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে সভায় আইসিস পরাস্ত হলেও কুর্দিস্তানে আরও কিছুদিন সেনা মোতায়েন রাখার প্রয়োজনের বিষয়ে ঐকমত্যের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইটে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে ( সূত্র: রেজ, বব উডওর্য়াড)। রাষ্ট্র পরিচালনার মত রাজনৈতিক প্রচারণায় এরকম অনেক গুরুত্বর্পূণ সিদ্ধান্ত তিনি টুইটারের মাধ্যমে প্রকাশ করায় অভ্যস্ত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও কট্টর ডানপন্থী কয়েকটি গোষ্ঠী মূলধারার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এধরণের নিষেধাজ্ঞার আশংকা বেশ কিছুদিন ধরেই করছিলো। ফলে, তারা বিকল্প কিছু প্লাটফর্ম ব্যবহার শুরু করে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছিলো পারলার। এখন টুইটারের অনুসরণে অ্যাপল এবং গুগল ঘোষণা করেছে তারা তাদের অ্যাপ স্টোরে এগুলো আর রাখবে না। ফলে, পারলার যে দ্রুতই একটা বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারবে, তেমনটা মনে হয় না।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদে যাঁর আরও ১০ দিন থাকার কথা তাঁর বিরুদ্ধে টুইটারের এই নিষেধাজ্ঞা যে একটা রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং এই বির্তকটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বৈশ্বিক। এই বিতর্কের দুটো প্রধান দিক আছে। প্রথমত: মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন এবং কোনো বহুজাতিক কোম্পানি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতমূলক এরকম পদক্ষেপ নিতে পারে কিনা? যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রশ্ন বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ। কেননা, তার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে অবাধ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে তার লংঘন ঘটছে কিনা। আর, দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে এই নিষেধাজ্ঞা কথিত জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকে আরও চাঙ্গা করে তুলবে কিনা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্যাখ্যা হচ্ছে সহিংসতার জন্য উস্কানি, ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার এবং সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে মহিমান্বিত করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজেই আইনসম্মত কাজ হিসাবে গণ্য হয় না। তবে, এই নিয়ন্ত্রণ আইনসম্মত কিনা তা বিচারের জন্য গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রয়োজন।
এটি কোনো কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসকের ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। কেননা, এধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপে তাঁরা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা ব্যবহারে অভ্যস্ত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমন ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগঠন অ্যান্টিফার সমর্থক ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ক্যাপিটল হিলে হামলাকারীদের দেশপ্রেমিক বলে বর্নণা করেছেন।
এই নিষেধাজ্ঞার রাজনৈতিক প্রভাব আগামী দিনগুলোতে আরও স্পষ্ট হবে। তবে, ইতোমধ্যেই যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির অনুসারীরা সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। ট্রাম্প জুনিয়র এবং সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এই নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ যদি টুইটার ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেন পারবেন না।এঁদের অনেকেই বিদ্বেষমূলক ও বিভাজনসৃষ্টিকারী বক্তব্য সেন্সর করার কারণে আগে থেকেই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে আসছিলেন। এখন তা আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।
এটা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনই সত্য অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও। উদাহরণ হিসাবে এখানে ভারতের কথা বলা যায়। টুইটারসহ প্রায় সবকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বাধিকসংখ্যক অনুসারী আছে যে রাজনীতিকের তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দলের অনেক নেতাও এসব মাধ্যমে ব্যপকভাবে তৎপর এবং বিপুলসংখ্যক ভক্ত-অনুসারী গড়ে তুলেছেন।
বিজেপি, শিবসেনা, আরএসএসসহ তাঁর রাজনীতির অনুসারীদের অনেকের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের অভিযোগ আছে। তাঁরা ইতোমধ্যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় বিস্ময় প্রকাশ করে ভারতে এসব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার দাবি তুলেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একইধরণের ব্যবস্থা যেন তাঁদের আদর্শের রাজনীতিকদের কারও বিরুদ্ধে নেওয়া না হয়। বিজেপির যুবনেতা তেজস্বী সূরইয়া এবং শিবসেনার প্রিয়াঙ্কা চর্তূবেদি গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার দোহাই দিয়ে এসেব কোম্পানির বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রযুক্তি খাতের
এসব বহুজাতিক ও বিশালাকারের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ও ক্ষোভ রাজনীতির ডান-বাম
সব পক্ষেরই রয়েছে। তাদের বৈশ্বিক বিস্তৃতির কারণে অনেক রাষ্ট্রেই অনেকক্ষেত্রেই তারা
স্থানীয় আইন-কানুনের বাইরে থেকে যায়। প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীরা তাদের বৃহৎ
পুঁজি ও কর্পোরেট স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতে ক্ষুব্ধ। এঁরা অনেকদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে
ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রাম কিম্বা কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে স্বাধীন
মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ করে আসছেন। এখন ডানপন্থীরাও এদের বিরুদ্ধে সরব হবে।
ফলে, প্রযুক্তি খাতের এসব প্লাটফর্মে পরিবর্তনের চাপ যে বাড়বে তা মোটামুটি নিশ্চিত
করেই বলা যায়।
(১০ জানুয়ারি,
২০২০-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন