বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার থেকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বৈশ্বিক প্রবণতা বোঝার কোনো উপায় নেই। অথচ বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২০ লাখ ছুঁতে চলেছে। ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার দুটি নতুন ধরণের কারণে সংক্রমণের গতি প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় বেশি বলেই আলামত মিলছে। শীত মৌসুমের শুরুতে ইউরোপ ও আমেরিকায় এই প্রবণতাটি প্রকট হলেও এখন দেখা যাচ্ছে এশিয়াতেও কোথাও কোথাও এই সংক্রমণের মাত্রা আগের চেয়ে বেশি। এই ধারায় সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন ঘটেছে ১৩ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার মালয়েশিয়ায় জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে। সেখানকার রাজা ইঙ্গিত দিয়েছেন জরুরি অবস্থা আগস্ট পর্যন্ত চলতে পারে। জাপানও আরেকটি নতুন ধরণের খবর দিয়েছে।
পশ্চিম গোলার্ধে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে, তা বোঝানোর জন্য দুটো পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করা যায়। ব্রিটেনে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, প্রতি পাঁচজনে একজন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। প্রাণহানির সংখ্যা ইতোমধ্যে ৮৫ হাজার ছুঁইছুঁই করছে এবং চলতি মাসে তা লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করে হচ্ছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও অবস্থা একই রকম। যুক্তরাষ্ট্রেও জানুয়ারিতে গড়ে দৈনিক সংক্রমণ আড়াই লাখ ও দৈনিক গড় মৃত্যুর হার ৩০০০এ দাঁড়িয়েছে। আমাদের উপমহাদেশের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে এখনও অনেকটা সহনীয় বলে একধরণের বিভ্রান্তি ব্যাপকভাবে চালু আছে। তবে, প্রথম ধাক্কায় যে ভুটানে কোনো মৃত্যু ঘটেনি এবং সংক্রমণের সংখ্যা কয়েক শতে সীমিত ছিল সেখানেও এবার মৃত্যু ঘটেছে। ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১৩ জানুয়ারির হিসাবে ১ কোটি ৪ লাখ এবং প্রাণহানি দেড় লাখের বেশি।
তবে ইতিমধ্যে প্রতিরোধক হিসাবে তিনটি টিকাও জরুরি অনুমোদন পেয়েছে এবং তার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল যে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যে টিকার সর্ব্বোচ্চ সুফল পেতে হলে এর ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্য প্রাপ্যতার ব্যাখ্যা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে যাদের এটি বেশি প্রয়োজন বা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে যারা, তাদের কাছে এটা পৌঁছাতে হবে। সেজন্যে উচ্চ ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সবজায়গায় এটির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর উৎপাদনব্যবস্থা ও সক্ষমতা এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে তা দ্রুত বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো যায়। বাস্তবে অবশ্য তেমনটি হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতা অনেকেই বাড়িয়েছে, কিন্তু তা নতুন কোনো দেশে হয়নি। বিশ্বের মোট উৎপাদনক্ষমতা যা এখন আছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চলতিবছরে মোট দুশো কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। মাথাপ্রতি দুই ডোজ করে হিসাবে চলতি বছরে মোট একশো কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে।
এই বাস্তবতার নিরিখে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কীধরণের নীতিকৌশলে বেশি সুফল মিলবে তার একটি রুপরেখা লন্ডনের ইমপিরিয়াল কলেজের বিশেষজ্ঞরা গতবছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছেন। জনসংখ্যার অনুপাত কিম্বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর অনুপাতের মত ছয়টি বিকল্প বিবেচনায় দেশগুলোর মধ্যে টিকা বিতরণে কীধরণের ফল মিলবে; অথবা উচ্চআয়ের দেশগুলোকে আগে কিম্বা নিম্নও মধ্যম আয়ের দেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে তা কতটা কার্যকর হবে, এগুলো সবই তাঁরা হিসাব করে দেখিয়েছেন। তাঁদের রুপরেখায় তাঁরা বলেছেন, কোনো দেশ জনসংখ্যার ২০ শতাংশের মতো মানুষের জন্য টিকা পেলে সেই দেশের উচিত হবে প্রবীণ এবং সবচেয়ে ঝুঁকির্পূণ জনগোষ্ঠীকে প্রতিষেধক দেওয়ার কৌশল নেওয়া। সরবরাহ বেশি পাওয়া গেলে কেবল তখনই অন্যান্য কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও শিশুদের ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
তবে বাস্তব পরিস্থিতি এখন অনেকটাই আলাদা। বিশ্বনেতারা স্বীকার না করলেও টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতা পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এর প্রধান কারণ তাঁরা নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের অগ্রাধিকার আদায়ের যে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাতে আছে স্বার্থপর জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই টিকা জাতীয়তাবাদের বিষয়ে কয়েকমাস ধরে সাবধানবাণী দিয়ে আসলেও কেউ তাতে কান দেননি।
পাশাপাশি পাশ্চাত্যের
উদ্ভাবিত টিকাগুলোর পিছনে সবার যতটা আগ্রহ, চীন ও রাশিয়ার টিকার ক্ষেত্রে তা নেই। ওই
দুই দেশ তাদের টিকার নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্ন্তজাতিক নিরীক্ষায়
মোটেও উৎসাহী নয। তারপরও তাদের টিকা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই পাঠানো হচ্ছে এবং সরবরাহের
প্রস্তুতি চলছে। মূলত, তারা তাদের উদ্ভাবিত টিকাকে কূটনীতির একটি উপাদান হিসাবে কাজে
লাগাচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সপ্তাহান্তে আফ্রিকার কয়েকটি দেশ সফরে গিয়ে আবারও
বলে এসেছেন, চীন তার টিকা সরবরাহে আফ্রিকাকে অগ্রাধিকার দেবে। তবে, চীনা টিকা চীনের
ভেতরে প্রয়োগ করা হলেও এখনও তা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি হয়নি। ভারতও টিকা কূটনীতিতে
চীনার সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন
অনুমোদন করেছে এবং নানা দেশে উপহার হিসাবে পাঠানোর
ঘোষণা দিয়েছে।
যে তিনটি টিকা এখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ফাইজারের টিকা। কিন্তু, এটি পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণে যে অতিশীতল তাপমাত্রা প্রয়োজন, তার কারণে এর ব্যবহার পাশ্চাত্যের অল্প কয়েকটি দেশেই সীমাবদ্ধ। এরপর আছে অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত অ্যাস্ট্রাজেনকার টিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকা। অ্যাস্ট্রাজেনকার টিকা অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে এখনো অনুমোদন পায়নি। যেসব দেশে টিকার সরবরাহ মিলেছে সেখানেও বিতরণ ব্যবস্থায় নানাধরণের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ব্রিটেনে এখন তিন/চার সপ্তাহ পরে যে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়ার কথা তা পিছিয়ে তিনমাস করা হয়েছে। অনেক বিতর্ক এবং ফাইজারের সাবধানবাণী সত্ত্বেও এটি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বল্পতম সময়ে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে কাজে ফেরানো যায়।
ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে টিকায় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে প্রবীণদের। প্রথম দফায় ৮৫বছরের ওপরে বয়স, বৃদ্ধনিবাসের বাসিন্দা এবং তাঁদের দেখভাল করেন যে পরিচর্যাকারীরা তাঁদেরই দেওয়া হয়েছে টিকা। এরপর পাচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবী এবং ৮০ বছরের ওপরে কিন্তু অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন এমন লোকজন। এরপর পর্যায়ক্রমে ৭৫+, ৭০+, ৬৫+, ৬০+ বয়সের গোষ্ঠী অগ্রাধিকার পাবে। স্বাস্থ্যসেবী ছাড়া অন্য কোনো পেশাজীবির আলাদা অগ্রাধিকার নেই। লন্ডনের পুলিশের কমিশনার মহামারি মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে কাজ করার কারণে পুলিশের এই সুবিধা পাওয়া উচিত বলে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
ভারত এবং বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোজেনকার টিকার অনুমোদন দিয়েছে। ভারতে এই টিকা দেওয়া শুরু হবে ১৬ই জানুয়ারি । ভারত সরকারের পরিকল্পনা আগামী অগাস্টের মধ্যে তারা ৩০ কোটি মানুষকে টিকা দেবে, যার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রতিমাসে তাদেরকে চার কোটিরও বেশি মানুষকে টিকা দিতে হবে।
বাংলাদেশে যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল সবার আগে টিকা পাওয়া যাবে, পরে বলা হয়েছিল ভারত যখন পাবে, আমরাও তখন পাবো। তবে, সরকারের সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা সম্ভব হতে পারে। অবশ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও দ্বিগুণ দামে। মাসে ২৫ লাখ করে ছয়মাসে দেড়কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার যে পরিকল্পনার কথা জানা যাচ্ছে, তার অগ্রাধিকারের তালিকা কতটা সুফল দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। স্বাস্থ্যসেবী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে পেশার চেয়ে বয়স এবং মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য জটিল রোগীদের অগ্রাধিকারই বিবেচ্য হওয়া উচিত। কার্যকর চিকিৎসার এবং পর্যাপ্ত টিকার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ থেকে রক্ষায় সুস্থ মানুষের চেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে অগ্রাধিকারের নীতিই কি যুক্তিযুক্ত নয়? দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান দুই মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্তের যথার্থতাও প্রশ্নাতীত নয়। দ্বিতীয় ডোজ বিলম্বিত হলে টিকার কার্যকারিতা কতটা অক্ষুণ্ন থাকবে বা দূর্বল হবে সেরকম কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু এখনও হয়নি।
(১৪ জানুয়ারি,
২০২০-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন