যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের বিদায়টা আজ মোটেও ভালো হলো না। তিনি মর্যাদার সঙ্গে বিদায় নিতে পারলেন না। শুরু থেকেই ‘আমিত্ব‘ ও নিজের ‘শ্রেষ্ঠত্ব‘ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মোহাচ্ছন্ন ট্রাম্পের বিদায়কে তাঁর কথা ধার করেই বলা যায় এমন প্রেসিডেন্ট আমেরিকা আর কখনো পায়নি। এতটা নিন্দিত বিদায় আর কারো হয়নি। তবে, এতোসব সমালোচনা-নিন্দার মধ্যেও একটি বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তিনি প্রেসিডেন্ট না হলে সম্ভবত সত্য যাচাইয়ের চর্চা এতটা গুরুত্বর্পূণ হয়ে উঠতো না এবং রাজনীতিকদের মিথ্যাচার ধরিয়ে দেওয়ার কাজটিতে সংবাদমাধ্যম এতটা নজর দিতো না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪৫৫ দিনে গড়ে দৈনিক ২১টি মিথ্যে বলেছেন অথবা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। মোট সংখ্যা ৩০ হাজার ৫২৯টি। হিসাবটি ওয়াশিংটন পোস্টের। সিএনএন এই হিসাব রাখতে শুরু করলেও একসময় খেই হারিয়ে ফেলে। গত অক্টোবরে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস জানায় মিথ্যার সংখ্যা এতো বেশি বেড়েছে যে সিএনএন এর তথ্য যাচাইকারী ড্যানিয়েল ডেল খেই হারিয়ে ফেলেছেন। মূলধারার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমই শুরু থেকে ট্রাম্পের কথার সত্যাসত্য যাচাইকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে শুরু করে। শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরের খবর খুঁজে বের করে আনার জন্য নজিরবিহীন সম্পদ ও মেধা বিনিয়োগ করেছে। মানতেই হবে ট্রাম্পের নির্বাচনী পরাজয়ে সংবাদমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। এই পটভূমিতে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বটাও ক্রমশই তীব্র হয়েছে। এঁদের বিরুদ্ধে ফেক নিউজ, ফেক মিডিয়া ও গণশত্রু এসব অভিধা তিনি নির্বিচারে প্রয়োগ করেছেন।
বিপরীতে, তাঁর অনুগত ও বিশ্বস্ত বিকল্প ধারাও শক্তিশালী হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্লাটফর্মগুলো তিনি যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছেন। আর, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিপুলভাবে নিন্দিত রুপার্ট মারডকের ফক্স নিউজ নির্বাচনে তিনি প্রত্যাখ্যাত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে মহিমান্বিত করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাঁর অনুসারীরা বিকল্প-সত্য বা অল্টারনেটিভ ট্রুথ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন মাধ্যম খুঁজে নিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ট্রাম্পের মধ্যে তাঁদের আদর্শ বাস্তবায়নের আশা খুঁজে পেয়েছেন। এঁদের জন্য গড়ে উঠেছে নিউজম্যাক্সের মতো আলাদা টিভি নেটওর্য়াক এবং পারলারসহ একাধিক নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যম। জল্পনা আছে যে ট্রাম্প নিজেও একটা টিভি চ্যানেল চালু করতে পারেন।
মিথ্যাচার ও ভন্ডামির মুখোশ উন্মোচন ছাড়াও জনস্বার্থের প্রতি সংবাদমাধ্যমের যে দায়িত্ব সেই ভূমিকাও নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষতির কারণ হয়েছে। এটি কতটা পরিকল্পিত, আর কতটা কাকতালীয়, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। উদাহরণ হিসাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার বিষয়ে সিএনএনের জনসচেতনতা বিষয়ক তথ্য প্রচারের কথা বলা যায়। গত জুলাইতে তারা লোকজনকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করার জন্য যে প্রচারাভিযান শুরু করে তার বক্তব্যগুলো ছিল এরকম : এটি একটি মাস্ক, এতে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার মোটিফ সম্বলিত একটি মাস্ক দেখিয়েই এই কথাগুলো বলা হয়। আরেকটি তথ্যকণিকায় বলা হয় একটি মাস্ক যিনি এটা পরছেন তাঁর সম্পর্কে অনেককিছুই বলে দেয়, তবে তার চেয়েও বেশি বলে, যিনি পরছেন না তিনি কেমন মানুষ সেটি। এতে স্পষ্টতই মাস্ক পরিধানকারীকে দায়িত্ববান নাগরিক এবং পরিহারকারীকে দায়িত্বহীন স্বার্থপর হিসাবে চিত্রিত করা হয়। দয়া করে মাস্ক পরুন বাণীর ওপর তাঁরা একটি শিরোনামও ব্যবহার করেছেন, যা হচ্ছে: সবার আগে প্রকৃত তথ্য বা সত্য ( ফ্যাক্ট ফার্স্ট)।
প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্প এবং তাঁর অনুসারীরা মাস্ক বাধ্যতামূলক করার এতোটাই বিরোধিতা করেছেন, যে যুক্তরাষ্ট্র
জুড়ে করোনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকলেও তাঁরা মাস্ক ছাড়াই বড় বড় প্রচারসভা করেছেন।
হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানেও মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়নি এবং সেখানকার অনুষ্ঠানসহ তাঁর
সব অনুষ্ঠানকেই বিশেষজ্ঞরা মহাসংক্রামক আয়োজন (সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট) হিসাবে চিহ্নিত
করেছেন। সংবাদমাধ্যমও সেভাবেই তা তুলে ধরেছে। আপাতদৃশ্যে একটা অরাজনৈতিক জনস্বার্থবিষয়ক
প্রচারাভিযানের রাজনৈতিক বার্তা যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজ করেছে, তাতে
কোনোই সন্দেহ নেই।
ট্রাম্পের মতবাদ বা ট্রাম্প-ইজম নিয়ে এখন বিস্তর আলোচনা চলছে এবং তা আরও অনেকদিন চলবে বলেই মনে হয়। হেরে গেলেও তাঁর ভোট বেড়েছে এবং তিনি হলেন দেশটির ইতিহাসে পুননির্বাচনে সর্বাধিকসংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত পরাজিত প্রেসিডেন্ট। পন্ডিতদের একটি বড় অংশের ধারণা, তাঁর সমর্থকদের অনেকেই সহজে দমবার পাত্র নন। রিপাবলিকান পার্টিকে তিনি যেভাবে কবজা করে ফেলেছিলেন, তাতে দলটি সহজে তাঁর প্রভাবমুক্ত হতে পারবে না। এতে করে তাঁর উগ্রবাদী সমর্থকরা আরও বেশি করে সংগঠিত হতে পারেন এবং তাঁর মিথ্যাচার একইভাবে দেশটিতে বিভাজন তীব্রতর করতে পারে।
আরেকটি দল অবশ্য মনে করেন, প্রেসিডেন্ট পদে থাকার কারণে তিনি এতোদিন আইন-আদালত থেকে নিজেকে যেভাবে বাঁচাতে পেরেছেন, এখন তা আর সম্ভব হবে না। ফলে, আইনী লড়াইতেই তাঁর সমস্ত মনোযোগ ও সম্পদ নিয়োগ করতে হবে। তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যও যে প্রতিকূলতার মুখে পড়বে, তাতে সম্ভাব্য দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি সামলানোও তাঁর জন্য কঠিন হবে। মিথ্যা এবং বিভ্রান্তির ধূম্যজাল সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ঘটলেও শেষসময়ে তাঁকে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আদালতে অন্তত ৬০ বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে একটি নির্বাচনে তাঁকে সবমিলিয়ে ৬১ বার পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে।
ট্রাম্পবাদের বিপদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করবে, সেই আলোচনা এই নিবন্ধের বিষয় নয়। এখানে শুধু সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাতেই আলোচনা সীমিাবদ্ধ রাখতে চাই। ক্ষমতাসীন ব্যাক্তি, তা সে তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, তাঁর কাছে জবাবদিহি চাইতে পারাই হচ্ছে সাংবাদিকতার মৌলিক দায়িত্ব। আর, সেই কাজে সত্য-মিথ্যার ফারাক করতে না পারা, কিম্বা না চাওয়া দুটোই ক্ষতিকর এবং অনাকাঙ্খিত। যুক্তরাষ্ট্রের সংবামাধ্যম সেই কাজে সফল। তবে, হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই কি সেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে? সিএনএন এর সত্য যাচাইকারি ড্যানিয়েল ডেল বলছেন জো বাইডেনের কথাগুলোও যাচাই করতে হবে। যেকোনো রাজনীতিকের কথাই যাচাইয়ের দাবি রাখে। তবে, যাঁরা কম কথা বলেন তাঁরা তো কম যাচাইয়ের মুখেই পড়বেন।
বিশ্বের নানাপ্রান্তে
অনেক জনতুষ্টিবাদী নেতাই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অনুকরণ করে রাজনীতিতে সাফল্য পেয়েছেন,
সেকথা তো অস্বীকার করা যাবে না। তাঁরা ক্রমশই তাঁদের ক্ষমতা সংহত করে চলেছেন। সে সব
দেশে বিভ্রান্তি বা মিথ্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করা তো দূরের কথা, তাঁদের দাপটের মুখে ভিন্নমত
প্রকাশ করাই কঠিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের
বেলায় যা করেছিল, এসব কতৃর্ত্ববাদিদের ক্ষেত্রেও সেই একইরকম নীতি অনুসরণ করছে। অর্থাৎ,
ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁরা যত মিথ্যাচারই করুন, বিদ্বেষ-বিভাজন তৈরি করুন, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো
তাতে বাধা দেবে না। ওইসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সাংবিধানিক
গ্যারান্টি (ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট) নেই। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য সেখানে সত্য
যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জটি তাই বহুগুণে কঠিন। বলে রাখা ভালো, ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট কিন্তু
নাগরিকদের মতপ্রকাশে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপই নিষিদ্ধ করেছে।
(২০ জানুয়ারি, ২০২০-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন