আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতার যে গুরুত্ব তার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারতের সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিত্ব খুবই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত একটি বিষয়। অবশ্য রাজনীতি কোনো সূত্র মেনে চলে না। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা যে নেহরু পরিবারের সেই পরিবারের কেউ সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে থাকছেন না। ইন্দিরা গান্ধীর পৌত্র রাহুল গান্ধী বিরোধীদলের নেতা হিসাবেও যে কোনো না কোনো আয়োজনে অংশ নিতে পারতেন না, ব্যাপারটা বোধ হয় তা নয়। রাজনৈতিক কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি অতিথি হলে তাঁরা সেরকম কোনো বিরোধিতা করতেন বলেও মনে হয় না। সুতরাং, রাজনীতির প্রসঙ্গটি আলোচনায় চলেই আসে।
কয়েকদিন ধরে ভারতের পত্রপত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে এই সফরকে তাঁর দেশের নির্বাচনী রাজনীতির প্রয়োজনেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কোলকাতার আনন্দবাজার কিম্বা দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস স্পষ্ট করে লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ। প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবারে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সব ধরণের কৌশলই গ্রহণ করছে। আর সেই কৌশলেরই অংশ হচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করা। সফরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে হলেও তাঁর সফরের অংশ হয়েছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলায় ওড়াকান্দির হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মন্দির এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালীমন্দির।
মতুয়া সম্প্রদায় পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কেন গুরুত্বর্পূণ তার বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকায় পার্থ প্রতিম ভট্টাচার্যের ‘মোদি অন টুইন মিশন‘ প্রতিবেদনে। তিনি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মতুয়া আছেন, যাঁদের মধ্যে ভোটার হচ্ছেন দেড় কোটি। রাজ্য বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসনে এই সম্প্রদায়ের ভোটেই ফলাফল নির্ধারিত হবে এবং আরও প্রায় ৬৩টি আসনে তাঁরা নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারেন। ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী, ( সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) সিএএ বাস্তবায়িত না হওয়ায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একধরণের হতাশা রয়েছে। মতুয়া জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বিভিন্নসময়ে দেশান্তরিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বাস করছেন।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পত্রিকাটিকে বলেছেন, মোদির ওড়াকান্দি সফর খুবই রাজনৈতিক। তিনি সেখানে যাচ্ছেন ভোটারদের সমর্থন চাইতে। সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসংঘের সাধারণ সম্পাদক মহিতোষ বৈদ্যও পত্রিকাটিকে বলেছেন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর ওড়াকান্দি সফর বিজেপিতে ভোট দিতে মতুয়া ভোটারদের অবশ্যই প্রভাবিত করবে। ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে প্রধানমন্ত্রীর সফরে মতুয়া সম্প্রদায় উদ্বেলিত বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী কার্যকর হলে ভারতের নাগরিকত্ব পাবে, এই আশায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে দলটি নজর কাড়া সাফল্য পায়। কিন্তু, রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে প্রসঙ্গটি ফিরে আসায় মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট নিয়ে বিজেপি কিছুটা উদ্বিগ্ন।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের ওড়াকান্তি আর শ্যামনগরের অংশটুকু প্রার্থনার উদ্দেশ্যে হলেও তা যে ভারতের একটি রাজ্যের ভোটের প্রচারকাজ হিসাবে চিত্রিত হতে শুরু করেছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী একটি পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে যে দলটি এই সুবিধা নিচ্ছে, সেই দলের নাগরিকত্ব আইনটি ইতোমধ্যেই বাংলাভাষী মুসলিমবিরোধী আইন হিসাবে ব্যপকভাবে সমালোচিত। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানও এই আইনটি বাতিলের জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই আইনে আসামে ইতোমধ্যে প্রায় ১৯ লাখ বাংলাভাষী, প্রধানত মুসলমান, নাগরিকত্ব হারিয়েছেন এবং তাদেরকে বাংলাদেশী হিসাবে অভিহিত করে দেশটি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আইনটি কার্যকর হলে কত লাখ বাংলাভাষী মুসলমান ভারতের নাগরিকত্ব হারাবেন সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে, তা যে আসামের চেয়ে অনেক বেশি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্মরণ করা দরকার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি ভারতে উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের সবচেয়ে বড় বোঝাটা বহন করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে তাই রাজ্যটির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। সেখানকার মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হলে হয়তো তিনিও ওড়াকান্দি যেতেন। তাহলে অন্তত নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দী একটি পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা উঠত না। আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং আয়োজক কমিটি এসব বিষয় বিবেচনা করেছেন কিনা, তা আমাদের জানা নেই। তবে, যেহেতু সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই ভারতের পত্রপত্রিকায় ওড়াকান্দি সফরের প্রস্তাব এবং ভোটের রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা ছাপা হচ্ছে, সেহেতু বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের ভূমিকা কোনোভাবেই যে উপেক্ষণীয় নয়, তার প্রমাণ তিস্তা, ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টনের প্রশ্নে আমরা দেখেছি। নাকি, আমরা ধরেই নিয়েছি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় পালাবদল ঘটছে?
ভারতের রাজনীতির বিষয়ে অন্য কোনো দেশের মতপ্রকাশকে দেশটির রাজনীতিকরা সব সময়ই প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। বিষয়টিতে দেশটির কূটনীতিকরা একটু বেশিই সোচ্চার। ভারতের কৃষকদের চলমান আন্দোলনের প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সমর্থন জানানোর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর বেশ কড়া বিবৃতি দিয়েছিল। গেল সপ্তাহে ব্রিটেনের হাউজ অব কমন্সে এমপিরা এবিষয়ে আলোচনা করলে ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডেকে নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে অভিযোগ করেছিল যে ব্রিটিশ এমপিরা তাদের ভোটব্যাংককে তুষ্ট করতে এধরণের বিতর্কের আয়োজন করেছেন। ব্রিটেনে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত, বিশেষত পাঞ্জাবি সম্প্রদায়ের প্রতি ইঙ্গিত করেই ওই ভোটব্যাংকের কথা বলা হয়।
অন্যদেশের
রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচনে ভারতের প্রভাব খাটানোর চেষ্টার বিষয়ে অবশ্য নতুন করে বলার
কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ‘আব কা বার ট্রাম্প সরকার‘ শ্লোগানটি প্রধানমন্ত্রী মোদিই
দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়ে বিরোধীদলগুলোর বয়কট ভাঙ্গতে তৎকালীন
পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের উদ্যোগের স্মৃতিও কারো বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়।সাবেক রাষ্ট্রপতি
ও জাতীয় পার্টির প্রধান জেনারেল এরশাদকে তিনি কী বলেছিলেন, তা প্রয়াত রাজনীতিকের জবানিতেই
আমরা শুনেছি।
বাংলাদেশ
যে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি ইস্যু হয়ে আছে তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
যদিও সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় আমাদের সরকার এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো
এবিষয়ে নীরবতা অনুসরণের নীতিই মেনে চলে। কিন্তু, মতুয়া ভোটব্যাংক প্রধানমন্ত্রী মোদির
সফরের অংশ হয়ে যাওয়ায় এখন নিশ্চিত করে বলা চলে যে, ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশের ভূমিকা
কোনো অংশেই কম গুরুত্বর্পূণ নয়।
(১৯
মার্চ ২০২১-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন