সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

৫০ বছরে বাংলাদেশ: মানচিত্র টেকসই হলো, গণতন্ত্র হলো কি

এ বছর বাংলাদেশ যেমন তার গৌরবময় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তেমনই বিশ্বের আরও তিনটি দেশ তাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব করতে পারে। তবে, ওই তিনটি দেশের সঙ্গে আমাদের ফারাক অনেক। আমরা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করেছি, রক্ত ঢেলেছি অকাতরে, প্রাণ দিয়েছি লাখে লাখে। ভিটে-মাটি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছি। মরহুম শিল্পী আব্দুল লতিফের ভাষায়, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারোর দানে পাওয়া নয়। সুতরাং, আমাদের আবেগের দিকটি যে অনেক বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

অন্য যে তিনটি দেশ ১৯৭১ এ স্বাধীনতা পেয়েছিল, তাদের একটির স্বাধীনতার তারিখ আমাদের মতোই ১৬ ডিসেম্বর। ওই তিনটি দেশই স্বাধীনতা পায় ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের কাছ থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয় দিবস যেদিনটি, সেই ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা পায় বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমীরাত বা ইউএই স্বাধীনতা পায় ২ ডিসেম্বর আর কাতার ১৮ ডিসেম্বর। এই তিন আরব দেশের নিরাপত্তা দেওয়া আর সম্ভব নয় বলে ব্রিটেন তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়। 

ওই তিনটি আরব দেশের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনা চলে না। তিনটি দেশই জ্বালানি তেল এবং গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। এদের মধ্যে মাথাপ্রতি সম্পদের বিচারে কাতার ২০১২ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের অবস্থান দখল করে নেয়। কাতারিদের মাথাপ্রতি বার্ষিক আয় ১লাখ ৬ হাজার ডলার। ইউএই পাঁচ দশকে বেদুইন অর্থনীতি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেশটির নাগরিকদের মাথাপ্রতি বার্ষিক আয় ৭০ হাজার ডলার। তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার মাত্র চার দশকে তিনগুণ বেড়েছে। আর, বাহরাইন সত্তুর দশকেই তেলের দামের উল্লম্ফনে বিপুলভাবে সম্পদশালী হয় এবং বর্তমানে আর্থিকখাতে অন্যতম দ্রুত  প্রবৃদ্ধির দেশ। বাহরাইনিদের মাথাপ্রতি বার্ষিক আয় ৫২ হাজার ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও ওই তিন দেশের অবস্থান বৈশ্বিক সূচকগুলোতে অনেক উপরের দিকে। তবে, তিনটি দেশেই জাতীয় জনসংখ্যার কয়েকগুণ বেশি হচ্ছে অভিবাসী নাগরিক এবং তাদের কোনোটিই গণতন্ত্র নয় । 

বাংলাদেশ যে তলাবিহীন ঝুড়ি নয় তা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীনতার শুরুতে যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও অভাব-অভিযোগ ছিল, সেগুলোর কারণে পাশ্চাত্যের কেউ কেউ আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে নানাধরণের সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার প্রথম দুই দশকের ইতিহাস অবশ্য কালিমালিপ্ত ও অস্থিরতার্পূণ। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড, রক্তাক্ত অভ্যূত্থান, পাল্টা অভ্যূত্থান, আরও একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা এবং সব মিলিয়ে প্রায় দেড় দশকের সামরিক শাসনের অধ্যায়। তবে, নতুন আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা ঘটে ৯০ এর গণজাগরণ ও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে।

দেশের মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় এবং অফুরন্ত উদ্যম ও চেষ্টায় অনেকক্ষেত্রেই এরপর থেকে নজর কাড়া অনেক সাফল্যই এসেছে। এসব সাফল্যের মূল কারিগর কৃষক, শ্রমিক এবং খেটে খাওয়া মানুষ। নগরায়ন এবং অবকাঠামোরও বড়ধরণের উন্নতি হয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই অবশ্য উন্নয়ন যাঁদের জন্য, তাঁদের মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়াই তা চাপিয়েও দেওয়া হয়েছে। সরকারের স্থায়ীত্বের সুবাদেও উন্নয়নের কৃতিত্ব রাজনীতির মূলধনে পরিণত হয়েছে। 

গত এক দশক ধরে এমনকি এই উন্নয়নই ক্রমাগতভাবে গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে যত বির্তকই থাকুক না কেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি যে ছয় দফা, তা যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নেরই অবকাশ নেই। সেই ছয় দফার প্রথম দফায় ছিল সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। এরপর আমাদের সংবিধানেও ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। 

ভোটাধিকার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও ব্যাক্তি স্বাধীনতার বর্তমান বাস্তবতা কী বলে? দেশের সর্বশেষ প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ আমরা পেয়েছিলাম ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে। কিন্তু ওই সংসদের মেয়াদ শেষের পর আর কোনো নির্বাচনই দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি, ভারত ও চীনের মতো যে কয়েকটি দেশ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে তারাও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলেছে। নির্বাচন নামক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাটির যে কতটা সর্বনাশ সাধন হয়েছে, তার স্বীকারোক্তি মেলে নির্বাচন কমিশনার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব তালুকদারের কথায়।

গণতন্ত্রের রকমফের নিয়ে সবচেয়ে নিবিড় গবেষণার জন্য সুখ্যাতি পেয়েছে যে প্রতিষ্ঠান, সুইডেনের সেই ভি-ডেম ইনিস্টিটিউট আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থাকে গত কয়েকবছর ধরেই নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদ বলে অভিহিত করে আসছে। তারা বলছে গত দশ বছর ধরেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়ে চলেছে। ভি-ডেম ইনিস্টিটিউট দেশগুলোর শাসনব্যবস্থার যে প্রকৃতি নির্ধারণ করে, সেটি তারা করে শুধুমাত্র নির্বাচন কেমন হয়েছে, তার ভিত্তিতে নয়। নির্বাচন কতটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে সেটা বিবেচনার পাশাপাশি সংগঠন করার স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থাও তাদের গুরুত্বর্পূণ বিচার্য বিষয়। তারা ১৯০০ সালের শুরু থেকে প্রতিটি দেশের শাসনব্যবস্থার তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করেই দেশগুলোর গণতন্ত্র কতটা অংশগ্রহণমূলক, কতটা উদার অথবা অনুদার বা স্বৈরতান্ত্রিক তা নির্ধারণ করে।

বাংলাদেশের বয়স যতটা, তার চেয়ে মাত্র একবছর কম বয়স হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের। ফ্রিডম হাউস ১৯৭২ সাল থেকে কোন দেশ কতটা মুক্ত , অর্থাৎ নাগরিক স্বাধীনতার মান মূল্যায়ন করে আসছে। তাদের মূল্যায়নে বাংলাদেশ হচ্ছে আংশিক মুক্ত একটি দেশ। তাদের ৪৯ বছরের বছরওয়ারি হিসাবে অবশ্য বাংলাদেশের স্বল্পকালীন ঝলসে ওঠা একটি পর্ব আছে। পরপর তিনটি বছর বাংলাদেশ ছিল একটি পুরোপুরি মুক্ত গণতন্ত্র। বছরগুলো হচ্ছে ১৯৯১ থেকে ৯৩ সাল। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পরের তিনটি বছর। স্মরণ করা যেতে পারে, ওই সময়টি ছিল দেশে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসার ঠিক পরের দিনগুলো। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং নাগরিক স্বাধীনতার মাত্রা বিবেচনায় ফ্রিডম হাউস বিভিন্ন দেশের ব্যাক্তি-স্বাধীনতার মূল্যায়ন করে থাকে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশ বাকি ৪৭ বছরের কোনো বছরেই আর পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। ১৯৭৫ সালে অবস্থা ছিল মুক্ত নয় এবং অন্যান্য বছরগুলোতে আংশিক মুক্ত।

নাগরিক স্বাধীনতার একটি বড়, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ, উপাদান হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি সূচক ২০০২ সাল থেকে প্রকাশ করে আসছে রিপোর্টাস স্য ফ্রঁতিয়ে নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর সহায়তায় এই সূচকটি তৈরি হয়। প্রথম সূচকটিতে আমাদের অবস্থান ছিল ১১৮তে। এরপর থেকে তার যে অবনমন শুরু হয়েছে তা এখন প্রায় তলানিতে। গত আট বছরে আমাদের অবস্থান ১৪৪ থেকে গেল বছরে তা ১৫১তে ঠেকেছে। 

আইনের শাসনের যে বৈশ্বিক সূচক সেখানেও আছে ধারাবাহিক অবনতির ছবি। ২০২০ সালের সূচকে যেমন অবনতি হয়েছে, তেমনই ১২৮টি দেশের তালিকায় আমাদের অবস্থানের আরও দুই ধাপ অবনমন ঘটে তা দাঁড়িয়েছে ১১৫তে। আইনের শাসনের মান নির্ধারণে ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট যে সব বিষয় বিচার করে, সেগুলোর মধ্যে সরকারি ক্ষমতার ব্যবহার, সরকারের স্বচ্ছ্বতা, দূর্নীতি, মৌলিক অধিকার, আইন-শৃংখলা ও নিরাপত্তা, তদারকি ব্যবস্থার কার্যকারিতা, দেওয়ানী বিচার এবং ফৌজদারি বিচারের বিষয়গুলোতে হয় অবনতি ঘটেছে নয়তো তা অপরিবর্তিত আছে। স্মরণ করা প্রয়োজন যে প্রধান বিচারপতিকে চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য করে  দূর্নীতির অভিযোগে তাঁকে অপসারণের নজির স্থাপনেও আমরা সম্ভবত অনন্য।  

একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা বলে থাকেন যে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে সবার আগে স্থান দিতে হবে। আগে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান, তারপর গণতন্ত্র। উন্নত দেশের কাতারে পা রাখার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের যে কর্মসূচি তাহলে কি সে পর্যন্ত আমরা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রেই আবদ্ধ থাকব? স্পষ্টতই, গণতন্ত্রের আগে প্রবৃদ্ধিিআমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ছিল না। গণতন্ত্রের মাধ্যমে আপন ভাগ্য গড়ার অধিকার দাবিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন দেশের সংবিধানে তাই আরও লেখা হয়েছে: রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা ( অনুচ্ছেদ ১৫)। দেশে ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের বর্তমান হার স্বাক্ষ্য দেয় কথিত উচ্চপ্রবৃদ্ধি এবং মাথাপ্রতি আয়বৃদ্ধিতে ধনীরা কতোটা অসমঞ্জস্যর্পূণভাবে লাভবান হচ্ছে। ২০১৯ সালের সরকারি পরিসংখ্যানেই ( বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ) দেখা গেছে দেশের বৈষম্য সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে। কৃষক-শ্রমিকের শোষণমুক্তি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

দেশের যে সম্পদবৃদ্ধি ঘটেছে, সেবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ১৯৭২ সালে আমাদের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই বাজেটের চেয়েও বেশি ( আটশো কোটিরও বেশি) টাকা চুরি হলেও দেশের অর্থনীতিতে তার কোনো প্রভাব অনুভূত হয় না। বরং, যিনি চুরি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি এখন দাপটের সঙ্গে উন্নয়ন অর্থনীতির তত্ত্ব প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার পাঁচ নম্বর দফায় আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হওয়া বন্ধের পথ বলা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে যায় না, পশ্চিমের দেশগুলোতে যায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকারও বেশি। সেই সময়ের হিসাবে পাচার হওয়া টাকায় আমাদের সরকারের  প্রায় পৌণে দুই বছরের খরচ মেটানো সম্ভব ছিল। ২০১৫-র পর থেকে অবশ্য সরকার বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তারিত বিবরণ বিদেশিদের হাতে যাতে আর না যায় সেই ব্যবস্থা করেছে। ফলে, গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই আর বাংলাদেশের অংকটা কষতে পারছে না। তাতে করে টাকার পাচার সহজ হয়েছে ছাড়া অন্যকিছু হয়নি। এগুলো যে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নমুনা, তা-তো মানতেই হবে! আমাদের টাকা আছে, তাই বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে।

সামাজিক সূচকগুলোতে অবশ্য বাংলাদেশের অগ্রগতির বৈশ্বিক স্বীকৃতি নিয়ে গর্ব করা যায়। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ানো, আনুষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলোতে প্রতিবেশিদের তুলনায় তো বটেই, এমনকি অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়েও আমরা অনেক এগিয়েছি। তবে, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সুনাম এনে দিয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, যদিও তার জন্য নোবেলবিজয়ী ড ইউনুসকে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে। ব্র্যাক (বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি) যে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিওতে রুপান্তরিত হয়েছে, তার নামের মধ্যেই আছে বাংলাদেশ। এরকম আরও অনেকের কথা বলা যায়, যারা মানুষের ঘরে সেই সব সেবা পৌঁছে দিয়েছেন, যেগুলো সরকারী খাতে হলে আমলাতন্ত্রের প্যাঁচে ঝুলে যেত। 

গণতন্ত্র ও ব্যাক্তি স্বাধীনতার অধিকারের লড়াই থেকে বাংলাদেশের জন্ম। গত ৫০ বছরে দেশে যাঁরা ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন , সাংসদ হয়েছেন বা বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, তাঁরা তা পেরেছেন সেই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিণতিতেই। কিন্তু, এখন আমরা এক নতুন ব্যবস্থা বা অভ্যাস চর্চা করছি বা তাতে অভ্যস্ত হচ্ছি। এই চর্চা হচ্ছে সহমত প্রকাশের, নতুবা মতপ্রকাশ থেকে থেকে বিরত থাকার। সহমত প্রকাশে ফায়দা হলো ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাওয়া, নয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা। আর, মতপ্রকাশে বিরত থাকার মানে হচ্ছে ব্যাক্তি ও পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ২০১৩-র একতরফা নির্বাচনের পর থেকে এরকম নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। কার্যকর বিরোধীদলহীন এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চিন্তা ও সৃজনশীলতা যে কতটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। এমন এক রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বই কি আমরা বর্তমানের তরুণ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মগুলোর রেখে যাবো? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রঙ্গিন ও আলো ঝলমলে উৎসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা দরকার।

(২৬ মার্চ ২০২১-র প্রথম আলোর স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী সাময়িকীতে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime in N

একটি জরিপ, নৈরাশ্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন

উন্নত গণতন্ত্রে সরকার , সরকারপ্রধান, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এবং বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুতে প্রায়ই জনমত জরিপ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো সংবাদমাধ্যম, আবার কখনো বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব জরিপ করায়। বেশ কিছু পেশাদার জরিপকারী প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা শুধু জরিপের কাজ করে। এসব জরিপ আমাদের গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন ভোটের মতো নয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু সেই ওয়েবসাইটের নিয়মিত ব্যবহারকারীদের মতামত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রায় দুই দশক বার্ষিক জরিপে রাজনীতির গতিপ্রকৃতির চমৎকার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জরিপ করতে গেলে সরকারের সায় আছে কিনা সেটা দেখা হয়, নইলে পেশাদার বিশেষজ্ঞরা বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো ওই দায়িত্ব নিতে চান না। কথা বলার ভয়ের মতো মতামত জানতে চাওয়াতেও এক ধরনের ভয়ের আসর পড়েছে। গণতন্ত্র প্রসারে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট, আইআরআই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা এখনো মাঝে মধ্যে স্পর্শকাতর রাজন

ভিসা নিষেধাজ্ঞা গুরুতর, সাংবাদিক নির্যাতন কী

একই দিনের দুটি সংবাদ শিরোনাম, ’৯ মাসে ২১৭ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার: আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ’পিটার হাসের বক্তব্য স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর চাপ, সমাবেশে সাংবাদিকনেতারা’। দুটো খবরই সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে। তবে একটি খবর, যাতে আছে সেই সব সাংবাদিকদের কথা, যাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শারীরিক ক্ষতি অথবা গ্রেপ্তার ও মামলার কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন; আর অন্যটিতে ভবিষ্যতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী যুক্তরাষ্ট্র যেতে চাইলে ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি বা তাঁর যে সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা। সাংবাদিকদের নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে গবেষণার কাজ ও তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে একটি মানবাধিকার সংগঠন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার দুশ্চিন্তায় প্রতিবাদী হয়েছেন সাংবাদিকদের অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্লাটফর্ম জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট।  বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির মত অধিকার লংঘনের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তারই অংশ হিসাবে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতার ওপর তাদের আলাদা মনোযোগ। তাদের প্রকাশিত হিসাব