প্রথম আলোয় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অনুসন্ধানী খবর ছাপানোর কারণে সুখ্যাতি পাওয়া সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের কারাগারের পথে খাঁচায় আটক মুখ কিম্বা সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একজন পদস্থ আমলার গলা চেপে ধরার ছবিগুলো শুধু যে সাংবাদিকদের জন্য কষ্টের ও ক্ষোভের, তা নয়; প্রথম আলোর পাঠক কিম্বা পাঠক নন এমন সাধারণ মানুষকেও এসব ছবি পীড়িত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে।
গত
কয়েকবছর ধরে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্রমাগত সংকোচন নিয়ে দেশ-বিদেশে উদ্বেগ
যে বাড়ছে, তা নতুন কোনো কথা নয়। সম্পাদক পরিষদও খোলাসা করে তাঁদের উদ্বেগের কথা
জানিয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক
বিভিন্ন বিধানের বিরুদ্ধে। তারা হয়রানি ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরির কারণে
স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণ বা সেল্ফ সেন্সরশিপের কথাও বলেছে। এই ‘কথা না বলতে পারার স্বাধীনতা‘র যে দমবন্ধ করা পরিবেশ, রোজিনার ছবিগুলো যেন তারই প্রতীক হিসাবে
সময়ের স্বাক্ষ্য হয়ে রইল।
সরকারি
আমলাদের রোজিনাকে বেআইনীভাবে অন্তরীণ রাখা, দেহ তল্লাশি, মোবাইল ফোন জব্দ করা এবং
অসুস্থ হওয়ার পরও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের ঘটনাগুলোতে
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মত আমরাও নিন্দা জানাই। বিশিষ্ট নাগরিক এবং বিভিন্ন
পেশাজীবিরা যেসব প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তার সঙ্গে আমরা সবাই কন্ঠ মেলাই। সঙ্গত
কারণেই আমরা এ সব ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের বিচার দাবি করি ।
একইসঙ্গে
অবশ্য দু:খ নিয়েই সরকারকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের একটি বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার
জন্য। বার্তাটি হচ্ছে শুধু বহুলনিন্দিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনই নয়, সরকারের
ভান্ডারে আরও হাতিয়ার আছে, যা ঔপনিবেশিক আমলের হলেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ
করতে তারা মোটেও দ্বিধান্বিত নয়। তা না হলে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রথমবারের
মত অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হতো না। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইনে এর আগে
কোনো সাংবাদিক অভিযুক্ত হয়েছেন, এমন নজির আমাদের জানা নেই।
আইন
বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতোই আমরাও এই আইন প্রয়োগের অন্য কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।
কেননা, আইনটি প্রধানত সরকারি কর্মচারিদের জন্যই প্রযোজ্য, যাঁদের বিভিন্নধরণের
গুরুত্বর্পূণ গোপনীয় বা স্পর্শকাতর তথ্য ও নথিপত্র নিয়ে কাজ করতে হয়। বিপরীতে,
সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে যাতে জনস্বার্থ আছে, এমন যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করে, তা প্রকাশ
করা। বিশ্ব জুড়েই জনস্বার্থে সাংবাদিকরা গোপনীয় তথ্য – এমনকি যুদ্ধকালীন সময়েও সামরিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর তথ্য
প্রকাশ করে থাকেন। পেন্টাগণ পেপার্সই হোক, কিম্বা ব্রিটিশ এমপিদের অন্যায্য ও ভুয়া
ভাতা উত্তোলনের তথ্যই হোক –
সাংবাদিকরা গোপনীয় নথির কপি হাতে পেয়েই এসব সাড়া জাগানো প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেশী
ভারতে বোফর্স কেলেংকারি কিম্বা রাফায়েল কেলেংকারির তথ্যও সাংবাদিকেরা যে প্রকাশ
করেছেন, তা-ও গোপন নথির ওপর ভিত্তি করে। রোজিনা যেসব সাড়া জাগানো প্রতিবেদন করেছেন,
সেগুলোর কোনোটিই কল্পনানির্ভর ছিলনা, যেমনটি অন্যান্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের
বেলায়ও একইভাবে প্রযোজ্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা, এমন সূত্রগুলোই সাংবাদিকদের
বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে। সাংবাদিকদের গোপনীয়তার সঙ্গেই সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হয়,
যেটাকে চুরি হিসাবে অভিহিত করা হচ্ছে ক্ষমতাধারদের বহুল ব্যবহৃত একটি কৌশল।
অফিসিয়াল
সিক্রেটস অ্যাক্টের কোনো ধারাই অজামিনযোগ্য নয়। কেবলমাত্র ৫ নম্বর ধারার একটি
উপধারায় বিদেশি শক্তির স্বার্থে এই সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত
হতে পারে বলে বলা আছে। কিন্তু, সেই ধারাও জামিন নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করেনি। আবার
পেনাল কোডের যে দুটি ধারা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোও জামিনযোগ্য। কিন্তু,
রোজিনার জামিনের শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিলম্বিত হচ্ছে এবং সেপর্যন্ত তাঁকে কারাগারেই
থাকতে হবে। এটি দু:খজনক। জামিন এমনিতেই প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। তার ওপর নারী এবং
একটি ছোট শিশুর মা হিসাবেও তার বিশেষ সহানুভূতি প্রাপ্য। বাস্তবতা হচ্ছে, যে
আমলারা তাঁকে সচিবালয়ে হেনস্থা করলেন, তাঁরা তাঁকে জেলে পাঠানোর একধরণের বিকৃত আনন্দ লাভ
করছেন।
স্বাধীনভাবে
কোনোধরণের ভয়ভীতি ছাড়া সাংবাদিকতা করতে পারার ক্ষেত্রে এগুলোই হচ্ছে প্রতিবন্ধক।
কোনো না কোনোভাবে জেল খাটানোর কৌশল হচ্ছে একটি গুরুত্বর্পূণ উপাদান। যে কারণে,
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো কার্যত অজামিনযোগ্য এবং তার অপব্যবহার এত বেশি।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর হিসাবে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে
কমপক্ষে ৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত
হয়েছেন কমপক্ষে ২ জন সাংবাদিক, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭০ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন
আরও অন্তত ৩০ জন এবং সাময়িকভাবে গুমের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৫ জন।
প্রশ্ন হচ্ছে , এই
ভীতিকর বাস্তবতায় বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা কি পরাস্ত হবে? কেউ যদি তেমনটি ভেবে
থাকেন, তাহলে ভুল করবেন। রোজিনাকে লাঞ্চিত করা এবং মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর পর
তাঁর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের যে সহমর্মিতা এবং সমর্থন দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবেই তাঁকে এবং এই পেশার অন্যদেরকে
আরও উজ্জীবিত করবে।
সহকর্মীর
লাঞ্চনায় যে সব সাংবাদিক ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁদের জন্য করণীয় শুধু রাস্তার প্রতিবাদ
নয়, প্রতিবাদটা কলম কিম্বা ক্যামেরাতেও হতে হবে। রোজিনার সহকর্মীদের একাংশ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বর্জনের মত কর্মসূচিও পালন
করেছেন। বলে রাখা ভালো, সংবাদ সম্মেলন বর্জনে কোনো সমাধান নেই , যদিও তাতে আবেগের
বহিঃপ্রকাশ আছে। সরকারের বক্তব্য এমনিতেও ছাপা জরুরি। কেননা, মানুষকে জানাতে হবে,
তাঁরা কী বলছেন। সুতরাং, তাঁদের একতরফা কথা প্রচার না করে সংবাদ সম্মেলনে হাজির
হয়ে প্রতিটি তথ্যের যথার্থতা যাচাইয়ে প্রশ্ন করতে হবে। সেগুলোর উত্তর পেলে, অথবা
না পেলেও পাঠক-দর্শক বুঝতে পারবেন, তাঁরা কতটুকু সত্য শুনলেন, আর কতটুকু অসত্য বা
অযৌক্তিক।
কোভিড
১৯ মহামারিতে দেশে মানুষ যখন মারা গেছে, যন্ত্রণা ও দূর্ভোগের শিকার হয়েছে, তখন
তা অনেকের জন্য দূর্নীতি, লুটপাট ও আরও ধনবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এই মহামারিতে
কারা লাভবান হয়েছে? কীভাবে হয়েছে? অনেকের কথাই আমরা অল্পস্বল্প জেনেছি। আরও অনেক
বেশি জানার আছে , অন্য অনেকের কথাও অজানা রয়েছে। উচিত হবে সেগুলো নিয়ে অন্যদের আরো
অনুসন্ধান চালানো ও বেশি বেশি প্রতিবেদন করা। সেটাই হবে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিবাদ।
তাতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার অধিকারও একটু একটু করে ফেরানো যাবে।
(১৯
মে, ২০২১‘র প্রথম
আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন