স্বদেশ ছাড়াও অন্য আরেকটি দেশের মুক্তির জন্য সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গৌরবের অধিকারী হিসাবে বাংলাদেশিদের একটা আলাদা ও অনন্য অবস্থান রয়েছে। কোনো ভাড়াটিয়া সেনা হিসাবে নয়, কিম্বা কোনো রাষ্ট্রীয় অনুরোধেও নয়। দখলদারিত্ব থেকে একটি জাতির মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের প্রতি রাজনৈতিক উপলব্ধি ও সংহতি থেকেই ছিল অসামরিক নাগরিকদের এই ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ। সেই দ্বিতীয় রাষ্ট্রটি হচ্ছে ফিলিস্তিন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অল্প পরেই বাংলাদেশ থেকে হাজারে হাজারে তরুণ ইজরায়েলী দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়ে বীরত্বর্পূণ ইতিহাস রচনা করেছেন।
মিশরের
আল আখবার পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণে ২০১৪ সালের এক নিবন্ধে এ সম্পর্কে দুটি হিসাব
পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা, পিএলও‘র প্রধান অংশ ফাতাহ‘র লেবানন শাখার
সম্পাদক ফাতি আবু আল আরাদাতের ভাষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে থাকা ছাড়াও শুধু
বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একটা আলাদা ব্যাটালিয়নও ছিল। পত্রিকাটি ১৯৮৮ সালের
যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সূত্র উল্লেখ করে বলছে তাদের হিসাবে প্রায় ৮
হাজার বাংলাদেশি ফিলিস্তিনিদের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু, সেই ফিলিস্তিন এখনও
দখলমুক্ত হয় নি, বরং বহুগুণ বেশি জমিন খুইয়েছে। সে সব বাংলাদেশি তরুণরা ফিরে
এসেছেন। এখন আর সেই লড়াইয়ে ভিনদেশীদের অংশগ্রহণের কথা শোনা যায় না।
দু:খজনক
খবর হচ্ছে, সেই ফিলিস্তিন মুক্ত না হলেও সেখানে যাদের দখলদারিত্ব ক্রমশ বেড়েছে ও
নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়েছে, সেই ইজরায়েলের সঙ্গে অঘোষিত সম্পর্কের সূচনা হয়েছে।
শেয়ারবিজ নামের এক অর্থনৈতিক দৈনিকে ৩০ মে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশের
সামান্য কিছু রপ্তানি দেশটিতে পাঠানোর মাধ্যমে এই কাজটি শুরু হয়েছে ঠিক দশ বছর
আগে। তবে পত্রিকাটি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে উদ্ধৃত করে বলেছে কীভাবে ও কী
পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় তা তিনি জানেন না। পত্রিকাটির তথ্যের উৎস
হচ্ছে সরকারের প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নযন ব্যুরো, যাদের কাছে প্রতিটি রপ্তানির
বিবরণ সংরক্ষিত থাকে। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও এই রপ্তানির হিসাব থাকার
কথা। সরকারি নথিপত্রে ইজরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যের তথ্য থাকলেও তা সরকারের মন্ত্রীদের
না জানার ব্যাখ্যা কী হতে পারে, তা নিয়ে কোনো জল্পনা না করাই ভালো।
রপ্তানি
উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, প্রথম কয়েকবছর গেছে শুধু তৈরি পোশাক। আর গত বছর তিনেক ধরে যাচ্ছে যক্ষাও
কুষ্ঠরোগের মত অসুখের প্রতিষেধক টিকা। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল। বাংলাদেশ
পোশাক রপ্তানিকারকের সংখ্যা হাজারের বেশি হলেও টিকা ও মোটরসাইকেল রপ্তানি করার
ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। ধারণা করি, অচিরেই তাঁদের পরিচয়ও
প্রকাশ পাবে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট থেকে হঠাৎ
করে ‘ইজরায়েল ব্যতীত‘ কথা দুটো তুলে দেওয়ার পর আমরা আশংকা প্রকাশ করেছিলাম হয়তো
কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ ও বিবেচনা এ ধরণের
সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। তাইওয়ানের বেলাতেও এমনটিই ঘটেছে।
শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের আশায় সরকারকে প্রভাবিত করে প্রায় দুই দশক আগেই পাসপোর্ট
থেকে ‘ব্যাতীত তালিকা‘ থেকে তাইওয়ানকেও
কোনোধরণের ঘোষণা ছাড়াই বাদ দেওয়া হয়। তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি
দেওয়া বা তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে চীন একটা বড় বাধা এবং সেই স্পর্শকতারতার কারণেই বাংলাদেশের
পাসপোর্ট দেশটির জন্য বৈধ নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হতো।
শেয়ারবিজের প্রতিবেদন এবং প্রথম আলো অনলাইনে সাংবাদিক আসজাদুল কিবরিয়ার নিবন্ধ সূত্রে এখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে ইজরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্যিক লেনদেন চলছে। আসজাদুল কিবরিয়া বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সলিউশন (ডব্লিউআইটিএস) তথ্যভান্ডারের উপাত্ত উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে ইপিবির হিসাবের চেয়ে প্রকৃত রপ্তানির পরেমাণ কয়েকগুণ বেশি। গত ১০ বছরে আসলে রপ্তানি হয়েছে ৩৩ কোটি ডলারের এবং আমদানি হয়েছে ৩৭ লাখ ডলারের ইজরায়েলি পণ্য। এসব উপাত্ত থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় করোনা মহামারির আগে ২০১৮ সালে বাণিজ্যে বেশ বড়ধরণের উলম্ফন ঘটেছে। তিনি অবশ্য বলেছেন যে ‘বিশ্বায়নের কালে বাণিজ্য আটকে রাখা সম্ভব নয়, বড়জোর সীমিত করে রাখা সম্ভব। আর যদি চাহিদা থাকে, তাহলে সোজা পথে না পারলে ঘুরপথে পণ্যের আসা-যাওয়া চলবে‘।
ইজরায়েল মুসলিমপ্রধান
দেশগুলোর নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে দেশটি ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক নিয়মনীতিই বদলে
ফেলেছে। যে সব দেশ ইজরায়েলে ভ্রমণ নিবৃত্ত করতে নানারকম ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে,
তাদের জন্য ইজরায়েল আর পাসপোর্টে ভিসার স্ট্যাম্প লাগায় না এবং দেশটিতে ঢোকা ও
বেরুনোর কোনো সিল-ছাপ্পড়ও দেয় না। আলাদা কাগজে ভ্রমণ অনুমতি দিয়ে থাকে। ইজরায়েলের
সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন দেশগুলোর হাজার হাজার মানুষ এই সুযোগ নিয়ে দেশটি
ভ্রমণও করে থাকেন। কিন্তু, তাতে করে পাসপোর্টে দেশটির সঙ্গে বৈধ সম্পর্ক না থাকার ঘোষণাটির রাজনৈতিক গুরুত্ব একটুও
ক্ষুণ্ন হয় না। বরং, আমরা সেই রাজনৈতিক গুরুত্বটা জেনেশুনে নষ্ট করছি, অথবা অসচেতনভাবেই
ইজরায়েলের হাতে বয়কটমুক্ত হওয়ার তৃপ্তি লাভের সুযোগ করে দিয়েছি। ইজরায়েলের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক টুইটে বাংলাদেশের পাসপোর্টের পরিবর্তনকে স্বাগত
জানানোর ভিন্ন ব্যাখ্যা আর কী হতে পারে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী
একে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য থেকে আমরা জেনেছি যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন
পাসপোর্টের এই পরিবর্তন ঘটেছে মাস ছয়েক আগে।
যার মানে হচ্ছে গতবছরের নভেম্বরের দিকে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল নির্বাচনী মৌসুম। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেকোনোভাবে
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করতে তখন মরিয়া। সেপ্টেম্বরে তাঁর
মধ্যস্থতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে ইজরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার
চুক্তি আব্রাহাম অ্যাকর্ড সই হয়েছে। আমিরাত ও বাহরাইন প্রধানত সামরিক ও নিরাপত্তা প্রযুক্তির
প্রয়োজনে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ইয়েমেনে হাজার হাজার বেসামরিক মৃত্যুর জন্য অস্ত্র
সরবরাহের পথে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিরোধিতার মধ্যেই আব্রাহাম চুক্তি সইয়ের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র
আমিরাতের জন্য শতকোটি ডলারের সমরসম্ভার বিক্রিতে সম্মত হয়। এরপর সুদান ও মরক্কো ট্রাম্প
প্রশাসনের চাপে যথাক্রমে অক্টোবর ও ডিসেম্বরে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেয়। বিনিময়ে সুদান
যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে মুক্ত হয়। আর, মরক্কোও আমিরাতের
মত শতকোটি ডলারের সমরাস্ত্র পেতে সক্ষম হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের অধিকাংশ
দেশই এখনও এধরণের সমঝোতায় রাজি হয়নি। সউদি আরব, কাতার, আলজেরিয়া ও ইরানের কথা
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়।
ইন্দোনেশিয়া
ও পাকিস্তানের পর বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ মুসলিমপ্রধান দেশের ভ্রমণ দলিল পাসপোর্টে
ইজরায়েলের বিষয়ে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা অপসারণের রাজনৈতিক মূল্যকে কোনোভাবেই খাটো করে
দেখার অবকাশ নেই। আব্রাহাম চুক্তিতে অংশ নেওয়ার জন্য ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের
ওপরে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের কথা আমরা
জানি। বাংলাদেশের বেলায় যে এরকম কিছু নেই, তা কি কেউ নিশ্চিত করতে পারেন? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের
প্রায় অভিন্ন চেতনা জলাঞ্জলি দেওয়ার বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি কী? এসব বিতর্ক এড়াতে
পাসপোর্টে পুরোনো কথাগুলো ফিরিয়ে আনতে আর বিলম্ব করা উচিত নয়।
(১
জুন, ২০২১-‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন