সম্প্রতি ভারতে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হলো চারটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। কিন্তু সব আলোচনা যেন শুধু পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও ভারতে শিক্ষা সংস্কারের জন্য খ্যাত লর্ড মেকলে বলেছিলেন, বাংলা আজ যা ভাবে ভারত তা ভাববে আগামীকাল। যদিও বক্তব্যটি ছিল অখন্ড ভারত নিয়ে, তবুও ধরে নেওয়া যৌক্তিক যে এই গৌরবের সমঅংশীদার বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশই। ২ মে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরপরই সুপরিচিত ভারতীয় লেখক সলিল ত্রিপাঠি এই বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে আশাবাদ প্রকাশ করেন যে হিন্দুত্ববাদী বিভাজনের রাজনীতির ধারক বিজেপিকে প্রত্যাখ্যানের সূচনা ,যা পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু হলো, তা ভারতের অন্যান্য অংশেও অনুসৃত হবে। কেরালা এবং তামিলনাড়ুতেও বিজেপি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আসাম অবশ্য ব্যাতিক্রম হয়েই রইল।
সলিল ত্রিপাঠির মত
আশাবাদীর সংখ্যা অনেক। অনেকে এমন কথাও বলতে শুরু করেছেন যে এই পাহাড়সম প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে
নির্বাচন জয়ের মাধ্যমে ভারতে মোদিবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার
লাভ করছেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। ‘দিদি, ও দিদি‘ বলে দিনের পর দিন প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদি যাঁকে ব্যঙ্গ করেছেন, সেই মমতাই হতে পারেন তাঁর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জার।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিজয়ী হলে পরিস্থিতি এতক্ষণে কী হতো, তা অনুমান করা কঠিন। তবে সীমান্তের উভয় পারেই একটা সর্বব্যাপী শঙ্কা ও উদ্বেগ যে ছিল, তা অস্বীকার করা যাবে না।
মমতা বন্দোপাধ্যায় টানা তৃতীয়বারের মতো মূখ্যমন্ত্রী হওয়ায় তাঁর প্রতি অভিনন্দন এবং
শুভ কামনা জানানোয় কার্পণ্য করা চলে না। তবে একটু নৈর্ব্যাক্তিক হলে বলতেই হয় যে তাঁর সাফল্যে মানুষ যতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিবোধ করেছে বিজেপির
পরাজয়ে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয় স্বস্তিদায়ক বটে, কিন্তু নিশ্চিন্ত বোধ করার মতো নয়। নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে রাজ্যটিতে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের যে ক্রম-উত্থান দৃশ্যমান হচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। বিজেপি জায়গা করে নেওয়ার আগে রাজ্যটিতে যেখানে তিনটি দল মোটামুটি শক্তিশালী ছিল, সেখানে দুটি দল – সিপিএম ও তার জোট এবং কংগ্রেস – ক্ষমতাকাঠামোয় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তৃণমুল কংগ্রেসের প্রধান নয়, একমাত্র বিরোধী শক্তি হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে বিজেপি। যার মানে হচ্ছে, তারাই শাসকদলের বিকল্প।
এই অবস্থা তৈরি কৃতিত্ব অথবা
দায় যা-ই বলা হোক না কেন, প্রধানত মমতা বন্দোপাধ্যায়ের। গত ১০ বছরে তিনি বামফ্রন্ট
এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে যে কঠোর দমনপীড়নের নীতি অনুসরণ করেছেন, তা তাদের প্রায় দিশেহারা
করে ফেলেছে। বামফ্রন্টের নেতাকর্মীদের এই ছত্রখান হয়ে যাওয়ায় সৃষ্ট শূণ্যতা পূরণে কংগ্রেসও
পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেসের এই ব্যর্থতা অবশ্য তাদের জাতীয় পর্যায়ে যে বন্ধ্যাত্ব
চলছে, তারই প্রভাবে প্রভাবিত। বিপরীতে, বিজেপির সহযোগী নানারকম সামাজিক সংগঠন ও ধর্মীয়
গোষ্ঠী অরাজনৈতিক খোলসে রাজ্যটিতে ঠিকই তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনের
ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যটিতে কার্যত দ্বিমুখী মেরুকরণ হয়েছে। ভোটের হিসাবে
তৃণমুল যেমন একক দল হিসাবে ৫০ বছরের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ ভোট পেয়েছে, তেমনই বিজেপির ভোটও নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটের বিপরীতে
বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং তিনটি আসন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই বিজেপির
ভোটের হার ২৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশ এবং আসনসংখ্যা ৭৪ আসন। অনেকে বিজেপির এই
ফলকে বলছেন জয়ের সমান হার।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমুলের
জয়ের পরও উদ্বেগ বা শংকার কারণ কী, তা এক টুইটে ব্যাখ্যা করেছেন আউটলুক সাময়িকীর রাজনৈতিক
সম্পাদক সাবা নাকভি। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে গতবছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লির নির্বাচনে
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির কাছে বিজেপি পরাজিত হওয়ার পর বিজেপি সমর্থকরা
নানা ধরণের অভিযোগ তুলতে শুরু করেন এবং হুমকি দিতে থাকেন। এরপর ফেব্রুয়ারির শেষদিকেই
দিল্লিতে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। বিজেপির যে নেতা ওই দাঙ্গার অগ্রভাগে ছিলেন
সেই কপিল মিশ্র যথারীতি অবাধে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। কিন্তু দাঙ্গার শিকার এবং প্রতিবাদকারীদের
অনেকেই এখনো বিচারাধীন হিসাবে কারাগারে আটক রয়েছেন। গুজব ছড়িয়ে, নানাধরণের স্পর্শকাতর
অজুহাত তুলে হাঙ্গামা তৈরি করা এখন তাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। কেননা, রাজ্যে
সরকারের বিকল্প তারাই। তৃতীয় দফায় মূখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথগ্রহণের পর মমতা বন্দোপাধ্যায়
রাজ্যটিতে ঘটে যাওয়া নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে
অভিযোগ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী
ফলাফলকে, অর্থাৎ তৃণমুলের বিজয়কে ইতিবাচকভাবে দেখায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু বিজেপির
জয়ের সমান হারকে স্বস্তিদায়ক হিসাবে দেখলে বড় ধরনের ভুল হবে। দিল্লির পরিকল্পিত মুসলিমবিরোধী
দাঙ্গার ঢেউ আমাদের স্পর্শ করেনি বলে সীমান্তের অপর পারের অনাকাঙ্খিত উত্তেজনার আঁচ
আমাদের গায়ে লাগবে না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
ওপর অনাকাঙ্খিত বিভিন্ন হামলা বা হয়রানির বিষয়ে ভারত যেভাবে প্রতিবাদ জানায়, আমাদেরও
এখন সেরকমটিই ভাবতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন রাজনীতির বিষয়ে আমাদের
উদ্বেগের কথা সময় থাকতে জানানোর ক্ষেত্রে দ্বিধা থাকলে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে।
এধরণের আশংকা আরও যে
কারণে বাড়বে তা হলো, ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী এবং জাতীয় রেজিস্ট্রার বাস্তবায়নে
বিজেপির অঙ্গীকার। মমতা বন্দোপাধ্যায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেন না বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন,
তার আলোকে বিজেপি কীধরণের কৌশল গ্রহণ করে, সেটিও একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়েই থাকছে।
পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনী
ফলাফলে দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভাবনার কারণ হয়ে আছে তার আঁচ মিলেছে মূলত সেখানকার নির্বাচনী
প্রচারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে
অংশ নিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময়কার কিছু বিষয়ে মমতা
ব্যানার্জী তাঁর ক্ষোভ নিয়ে কোনো রাখঢাক করেননি। সেই সময় নরেন্দ্র মোদী যে গোপালগঞ্জের
ওড়াকান্দির মতুয়া সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন, তা নিয়ে
নির্বাচনী জনসভায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জী এবং নির্বাচন
কমিশনের কাছে তাঁর দল আপত্তিও জানিয়েছে। ভারতীয় সাংবাদিকরা এমন কথাও জানিয়েছেন যে
, মমতা বন্দোপাধ্যায় বিষয়টিকে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের
সহযোগিতা হিসাবে দেখেছেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছেন, যত দিন নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী
থাকবেন, তিনি তাঁর সঙ্গে ঢাকায় যাবেন না। স্পষ্টতই ইঙ্গিত মেলে যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের
প্রশ্নে তিনি বিজেপিকে সহায়তা করতে নিরুৎসাহী হবেন। আর, তার চেয়েও খারাপ হতে পারে এক্ষেত্রে
তাঁর সম্ভাব্য অসহযোগিতা।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে
তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির প্রশ্নে তাঁর বিরোধিতার কথা সবারই জানা। তবে, সাবেক পররাষ্ট্র
সচিব তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য এবিষয়ে যৌক্তিক বলেই মনে হয়। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে জয়ী হলেও
রাজ্যের রাজনীতির প্রয়োজনে তিস্তার পানি চুক্তিতে সম্মত হতো না। তিস্তা ছাড়াও অন্যান্য
নদীর পানি ভাগাভাগিসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা কতটা গুরুত্বর্পূণ, সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে, যেকথাটি বলা প্রয়োজন, তা হোল আমাদের পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, যা এই অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করেছে। কার্যকর গণতন্ত্রে অবশ্য
এধরণের বিভ্রান্তির জবাবদিহি এড়ানো সম্ভব ছিল না।
(৭ এপ্রিল, ২০২১‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন