ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষায় সরকার নতুন একটি আইন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এসব আলোচনা আপাতদৃশ্যে খুবই জরুরি, তবে তা আদৌ কোনো কাজে আসবে বলে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। অতীতের রেকর্ড অন্তত তা-ই বলে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথাই স্মরণ করে দেখুন। এর পূর্ববর্তী আইন - তথ্য প্রযুক্তি আইনের নিবর্তনমূলক বৈশিষ্ট্য ও যথেচ্ছ অপব্যবহারের প্রতিবাদের মুখে ডিজিটাল আইনের খসড়া নিয়ে কত আলোচনাই না হলো। সরকারের ক্ষ্মতাধর মন্ত্রীরা একযোগে আমাদের আশ্বস্ত করলেন, আমাদের উদ্বেগগুলো বিবেচনা করা হবে। যাঁর হাত দিয়ে আইন হয়, পেশাদার আইনজীবী আইনমন্ত্রী সম্পাদক পরিষদকেও কথা দিলেন, অচিরেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে। পরিবর্তন তো দূরের কথা, ওই আইনে এতো বেশিসংখ্যক সম্পাদক- সাংবাদিক মামলায় পড়েছেন ও জেলে গেছেন যে তার হিসাব রাখাই কঠিন।
গণমাধ্যমের আলোচনা কিম্বা ময়দানের বক্তৃতা ও রাজপথের শ্লোগান কোনোকিছুই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের ওপর কোনো দাগ কাটে না। আমাদের কথিত `গণতন্ত্রে` সাংসদদের কাছে যেহেতু ভোটারদের কোনো মূল্য নেই, তাই সংসদে বিল উত্থাপিত হলে কোনো বিতর্কের দরকার পড়েনা, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়ে যায়। আইন তৈরির সময়ে তার খসড়ায় আইনের উদ্দেশ্য বলা থাকে। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, ``যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।`` এ ক্ষেত্রে ব্যাক্তি বা নাগরিক শব্দগুলো একেবারেই অনুপস্থিত। বোঝাই যায় ডিজিটাল নিরাপত্তার যে কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে ডিজিটাল জগতে সরকার ও সরকারের লোকজনের নিরাপত্তা। নাগরিকের সুরক্ষা এখানে প্রাধান্য পায়নি।
যে কোনো প্রস্তাবিত অইনের বিষয়ে তাই প্রথমেই মৌলিক যে প্রশ্নটি জানা জরুরি, তা হলো কার প্রয়োজনে সেটি করা হচ্ছে? নজির হিসাবে এখানে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক প্রাতিষ্ঠান, বিটিআরসির আইনের আলোচনাও করা যায়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করা হয় এবং এটি এখন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন ২০১০ নামে পরিচিত। এই সংশোধনে মূল আইনের কয়েকটি ধারায় `টেলিযোগাযোগ` কথাটি সংশোধন করে `টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ` করা হয়। ১৬ নম্বর দফায় `কমিশন` শব্দ `সরকার` দ্বারা প্রতিস্থাপন করে কার্যত ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতাও সরকার নিয়ে নেয় । নিয়ন্ত্রণ এবং আপাতদৃশ্যে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কমিশনের ক্ষমতা অধিগ্রহণই যে আইন তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য, তার আদর্শ নজির এর চেয়ে বেশি আর কী হতে পারে?
নাগরিক প্রত্যাশা ছিল টেলিসেবার ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষাই হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের`( বিটিআরসি) কাজ। বাস্তবে হয়েছে উলটো। ভোক্তার স্বার্থ এখন শুধু দুর অস্তই নয়, মনে হয় এটি এখন সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নয়তো এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছে যে বিরোধীদলের লোক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ফোন আলাপ ফাঁসের অনাচারের বেলায় গত এক দশকে তারা শুধুই দর্শক। আমাদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও কথিত নিরাপত্তার অজুহাতে ফোনের জন্য বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন চাপিয়ে দিয়েও ব্যাক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গ্রাহকদের তথ্য এখন কত দেশি-বিদেশী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে পৌঁছে গেছে, তা তারাও জানেন কি না সন্দেহ। নাহলে এতো পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপনের ক্ষুদে বার্তার অত্যাচার আমাদের সইতে হতো না। আর সিম ক্লোনিং নামক ব্যবস্থায় পরিচয় চুরি ও তা ব্যবহার করে জালিয়াতি ও প্রতারণার ভয়াবহ ঘটনাগুলোর রেকর্ডই-বা তারা কীভাবে অস্বীকার করবে।
টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে তাঁদের এখন প্রধান মাথাব্যাথা যেন সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ। আনুগত্য ক্রয় ও ভীতির পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে মূলধারার মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য মোটামুটি পূরণ হওয়ার পর এখন নিয়ন্ত্রণের পরিধি বাড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিন্নমত দমনই যে সরকারের লক্ষ্য সে বিষয়ে কোনো রাখঢাক নেই। সরকারের উদ্দেশ্যসাধনে বিটিআরসি যে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ফাঁস হওয়া ভিডিও অপসারণে বিদেশীরা তাদের কথা শোনেনা বলে তাঁরা এখন চায় বাংলাদেশে তথ্যের আধার বা সার্ভার স্থাপন ও অফিস করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হোক। অথচ জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ বা সাংবাদিকতার ব্যতিক্রম (যেমন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠতার ভিডিও) ছাড়া অন্য যেসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আড়িপাতা ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেগুলো বন্ধ করতে না পারার দায় তারা গ্রহণ করছে না।
প্রস্তাবিত ‘পারসোনাল ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ বিষয়ক আলোচনায় এই পটভূমি ও নজিরগুলো বাদ দিলে তাতে নতুন আইন তৈরির উদ্দেশ্য যেমন বোঝা যাবে না, তেমনই নাগরিক অধিকা্রের ওপর তার প্রভাব ও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ উপেক্ষিত থেকে যাবে। টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বা্রের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। গত জুনে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক ও ইউটিউবের কাছে যত তথ্য চেয়েছে, তার মাত্র ৪০ শতাংশ দিয়েছে ফেসবুক ও ইউটিউব। তারা শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসসংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু কোনো নাগরিক যদি জঙ্গিবাদ বা গুজব ছড়ায়, তখন আর তথ্য দেয় না। তারা বলে, এগুলো বাক্স্বাধীনতা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যথেষ্ট নয়। এ সমস্যা সমাধানে নতুন আইন করা হচ্ছে। তার খসড়াও করা হয়েছে।” সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো জংগীবাদের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায় - এমন দাবি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, “আমরা চাই না আমাদের নাগরিকদের তথ্য অরক্ষিত থাকুক। ফেসবুক ও গুগল এখন নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি। সামনের দিনগুলোয় তথ্য হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। মানুষ বুঝে বা না বুঝে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য ফাঁসের ঘটনাও ঘটেছে” (ব্যাক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রণ চায় সরকার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, প্রথম আলো)। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু কোনোধরণের বিচারিক প্রক্রিয়া ও তদারক ছাড়াই আইন-শৃংখলাবাহিনী এসব তথ্য ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে,,যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে অনেকেই ইউরোপের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) এর কথা বলেছেন। সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপ আইন করেছে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষিত করতে, ওইসব ব্যাক্তিগত তথ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য নয়। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি বা প্রযুক্তি দৈত্য হিসাবে পরিচিতি পাওয়া কোম্পানিগুলোর সার্ভার নিজেদের সীমানায় স্থাপনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নয়। ব্রিটেনে ব্রেক্সিট ভোটের পর এই ডেটার রাজনৈতিক ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ ওঠে এবং ব্রেক্সিটপন্থী একাধিক অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ব্রিটেনের স্বাধীন তথ্য কমিশনার জরিমানাও করেছেন। নাগরিক স্বার্থে ওই দপ্তরের ভূমিকার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্তও দেওয়া যায়। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, মাস্টারকার্ড, টি মোবাইলের মত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ( জন্মতারিখ, ঠিকানা, ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ইত্যাদি) তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে ওইসব কোম্পানিকে জরিমানা ও গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। সন্ত্রাস দমন বা গুরুতর অপরাধ মোকাবিলায় ব্যাক্তিগত তথ্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আছে বিচারিক তদারকির বিধান।
আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে সরকারের হয়ে কাজ করা যে কাউকেই এগুলো ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া, যাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য খ্যাত ও জবাবদিহির উর্ধ্বে বলে প্রতিষ্ঠিত। তারপরও প্রস্তাবিত আইনে তাঁদের জন্য সরল বিশ্বাসের অজুহাত জুড়ে দিয়ে তাঁদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া এসব বিষয়ে অর্থবহ কোনো আলোচনা অসম্ভব। তাই বলে অবশ্য নীরবতাও কোনো কাজের কথা নয়। এধরণের অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন তৈরির উদ্যোগের বিরুদ্ধে তাই নাগরিক প্রতিবাদের কোনো বিকল্প নেই।
(১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন