উপজেলা পরিষদের বিষয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দুটি নির্দেশনা এসেছে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে,রুপালি পর্দার বহুল আলোচিত তারকা পরীমনির রিমান্ড, ই-ধাপ্পার বিভিন্ন কারবারিদের হাজার কোটি টাকা লোপাটের কাহিনি, সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব নিয়ে টানাটানির মত বিষয়গুলোর ভিড়ে উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন ও মর্যাদার বিষয়ে উচ্চ আদালতের এই দুটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।
বলে নেওয়া ভালো, ক্ষমতাসীন জোট ও নির্বাচন কমিশন দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় উপজেলা চেয়ারম্যানরাও জনপ্রতিনিধির মর্যাদা হারিয়েছেন।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সংস্কৃতিতে নাগরিকেরা যখন অসহায়, তখন জনগণের অংশগ্রহণ-বর্জিত রাজনীতির এই খেসারত তাঁরা এড়াবেন কীভাবে?
তবে উপজেলা চেয়ারম্যনের আসনে যে-ই আসীন থা্কুন না কেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তাঁদের পদের আইনপ্রদত্ত মর্যাদা ও ক্ষমতা অন্য কেউ হরণ করবে, সেটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সেকারণেই হাইকোর্টের এই আদেশ দুটি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। বিষয়টিতে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের ঘাটতি লক্ষ্য করে জেলা ও দায়রা আদালতের একজন বিচারক আমাকে লিখেছেন, এই আদেশ যে কতটা যুগান্তকারী, প্রকট অগণতন্ত্রের এই মহামারির মধ্যে জনপ্রতিনিধিদের (গণতন্ত্রের) এই অধিকার প্রতিষ্ঠা যে কতোটা তাতপর্যপূর্ণ, তা মনে হচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনুধাবন করতে পারছে না।
১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রতিটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে উপজেলা পরিষদ ভবনের সাইনবোর্ডে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের বেঞ্চ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের পরিবর্তে উপজেলা পরিষদ কার্যালয় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেওয়ার বৈধতা নিয়ে তিনজন উপজেলা চেয়ারম্যানের এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত এই অন্তর্বর্তী আদেশ দেন। একইসঙ্গে আদালত উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ধারা ১৩ (ক) ১৩ (খ) ও ১৩ (গ) কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছেন। এই ধারাগুলো উপজেলা চেয়ারম্যানদের অপসারণ ও সাময়িক বরখাস্তকরণ বিষয়ক। আদালতের বিচারাধীন এসব বিষয় নিয়ে আপাততঃ আমাদের আলোচনার কোনো অবকাশ নেই। আমরা শুধু আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের বিষয়েই আলোচনা করতে পারি।
এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত সব দফতরের কার্যক্রম পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে ও বিধি অনুসারে করার জন্য ইউএনওদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এই মামলার পটভূমি হচ্ছে ১৭টি বিভাগের কাজ উপজেলা পরিষদের ওপর অর্পিত হলেও সেগুলোর বেলায়ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাই ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন। ওইসব বিভাগ যেসব মন্ত্রণালয়ের অধীন সে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবরা চেয়ারম্যানদের পরামর্শক্রমে কাজ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য পরিপত্র জারি করায় সংক্ষুব্ধ চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে রিট আবেদন করা হলে আদালত এই নির্দেশ দিয়েছেন।
যে বিচারক আমার কাছে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, তিনি অবশ্য একইসঙ্গে এমন আশংকাও প্রকাশ করেছেন যে আদালতের নির্দেশনা আদৌ প্রতিপালিত হবে কি না। তাঁর আশংকা মোটেও অমূলক নয়। জনপ্রতিনিধিদের যে আমলারা এখন খুব একটা পরোয়া করেন না সেই অভিযোগ তো আমরা প্রবীণ সাংসদদের মুখ থেকেই শুনেছি। বরিশালে সিটি করপোরেশনের মেয়রের সমর্থকদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পদমর্যাদায় মেয়রের বিপরীতে নিম্নপদস্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে জেলা প্রশাসকের যে দাপট প্রকাশ পেয়েছে, তাতে উপজেলা চেয়ারম্যানদের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায় তা অনুমান করা কঠিন নয়। আমলাদের উতসাহ ও প্ররোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল এবং আদেশের কার্যকারিতা স্থগিতের আবেদনের সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওই বিচারক আমাকে একথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আপিল দায়ের করে হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ না পেয়েও সরকার সেই আদেশের বাস্তবায়ন ঝুলিয়ে রেখেছে, এমন নজিরের অভাব নেই।
আদালতের নির্দেশনা পালিত হলো কি না বা চেয়ারম্যানরা কেউ নিরাপত্তারক্ষী পেলেন কি না সে রকম কোনো খবর গত একসপ্তাহে আমার নজরে আসেনি। হতে পারে বিনা ভোটের বা বিনা প্রতিদ্বন্দিতার চেয়ারম্যানদের জন্য করদাতাদের টাকা খরচ নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয় বলে অনেকে ভাবতে পারেন। কিন্তু তেমন ভাবনা কি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় অন্য যাঁরা নানাপদে আসীন হয়েছেন, তাঁদের বেলায় কেউ বলেছে? কিম্বা রাতের ভোট সম্ভব হয়েছে যে আমলাদের কারণে তাঁদের বেতন-ভাতায় স্ফীতির বিষয়ে কি আমরা কিছু করেছি? এই আমলারাই হটাত করে উপজেলা পরিষদের সাইনবোর্ড বদলে ফেলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ত্ব নাকচ করে দিয়ে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করেছেন। সম্ভবতঃ এ কারণেই বরিশালের জেলা প্রশাসক ইউএনওকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি বলে দাবি করতে পারেন।
উপজেলা পরিষদ অবশ্য সরকারের অন্য নীতির কারণেও কিছুটা দূর্বল হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে সাংসদদের উপজেলা পরিষদে উপদেষ্টার ভূমিকা দেওয়ার আইন। উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সাংসদের দ্বন্দ্বে কত উপজেলায় কত উন্নয়ন প্রকল্প দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে তার কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব পাওয়া যায় না। তবে,অভিযোগ ঠিকই শোনা যায়। আইনপ্রণেতাদের উন্নয়ন কার্যক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করার বিরুদ্ধে সব যুক্তি প্রত্যাখান করা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের আন্দোলনেও সরকার অনড় থেকেছে। সাংসদদের তদারককারির ভূমিকা দিয়ে এবং আইন লংঘন করে প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে ক্ষমতায়িত করে গত এক দশকে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে।
উপজেলা ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সেকারণে তখন সব রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতায় এককাট্টা ছিল। ছাত্র আন্দোলন থেকেও উপজেলা বাতিলের দাবি জানানো হয়েছিল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সফল হওয়ার পর বিএনপি প্রথমবার নির্বাচিত হলে উপজেলাব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়। আওয়ামী লীগ উপজেলা পদ্ধতির পুনরুজ্জীবন ঘটালেও তার প্রকৃত ক্ষমতায়নে কতটা আন্তরিক, তা এখনও প্রমাণিত নয়। বস্তুতঃ আইনে বিধান রাখা হয়েছে যে উপজেলা পরিষদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ক্ষমতা থাকবে। সুতরাং, সরকার যখন অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়ছে, তখন স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে মনে করার কোনো কারণ নেই।
সন্দেহ নেই আদালতের সাম্প্রতিকতম আদেশ দুটি বাস্তবায়িত হলে উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা ও মর্যাদাহরণের কিছুটা প্রতিকার মিলবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরিষদকে যে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কথা, তাঁরা তার বাইরে চেয়ারম্যানদের ক্ষমতায় যাতে অনাকাংখিত ভাগ বসানোর চেষ্টা না করেন, তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ জ্রুরি।
(২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন