সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আইনের আগে দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা

 বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার কারণেই কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নতুন করে আলোচনায় ফিরে এসেছে। ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ জন্য আইন তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। আর ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা বলেছেন এর আগেও যেভাবে কমিশন গঠিত হয়েছে, এবারও সেভাবেই হবে। সার্চ কমিটি উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে সেই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশনারদের নিয়োগ করবেন। বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি যে  বিরোধীদল বিএনপির পছন্দ হয়নি, সেকথা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দিতার পর প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিরোধীদলের আসনে আসীন জাতীয় পার্টিও কমিশন গঠনের জন্য আইন তৈরির কথা বলেছে। এসব বক্তব্যে স্পষ্টতই বোঝা যায়, নতুন কমিশন গঠনে আইনের কথা সংবিধানে থাকলেও তার আবশ্যকতা নিয়ে রাজনৈতিক কোনো মতৈক্য নেই। 


তবে এই নেতিবাচক অবস্থানের মধ্যেও মন্দের ভালো একটি উপাদান আছে। রাজনীতির প্রধান এই দুই প্রতিপক্ষ - আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই কমিশন গঠনের আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। অতীতেও তারা তা প্রয়োজনীয় মনে করেনি এবং আইন তৈরির চেষ্টাও করেনি। আইন না থাকলে তাঁদের যে কিছুটা সুবিধা হয়, সেটা বোধহয় নতুন করে বলার অবকাশ নেই। অবশ্য সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়ার পরও যে কমিশন ও সরকার সবসময় নির্বাচনী আইন মেনে চলেছে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না। কেন বলা যাচ্ছেনা, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বর্তমান কমিশনের একজন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সাম্প্রতিকতম এক বক্তব্যে। 


২২ সেপ্টেম্বর মাহবুব তালুকদার বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে চলমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব না। নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনে বহুদলের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের কারণ বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য। ভোটারদের নির্বাচন বিমুখতাও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। তিনি বলেন, এই সব কিছুর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা জড়িত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।


নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কথায় স্বীকারোক্তি আছে যে মানুষ নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় আস্থা হারিয়ে ফেলায় এখন নির্বাচন শুধু যে প্রতিদ্বন্দিতাহীন হয়েছে তা-ই নয়, ভোটাররাও ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনার দায় মেনে নিয়েও তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া  অবস্থা বদলানো সম্ভব না। তিনি যে এবারই প্রথমবারের মত এই কঠিন বাস্তবতার কথা বললেন, তা নয়; দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় সব কটি নির্বাচনের পর তিনি এধরণের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক দল কিম্বা নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর কেউই তাঁর বক্তব্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। হতে পারে ক্ষমতাসীন দলের দাপটের মুখে এধরণের অপ্রীতিকর বিষয়ে কথা বলে কেউই সরকারের রোষানলে পড়তে চাননি। সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন ও বাসদের প্রয়াত নেতা মঈন উদ্দীন খান বাদল নিজেরা কীভাবে ভোট ছাড়াই বিজয়ী ঘোষিত হয়েছিলেন, সে প্রশ্ন করে তিরস্কৃত হয়েছিলেন, সে কথা আমরা সবাই জানি। 


নতুন কমিশন গঠনের সময় ঘনিয়ে আসায় এখন আর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। সুতরাং আলোচনা শুরু ও সম্ভাব্য সমাধানের একটি প্রস্তাব তুলে ধরার জন্য বিবৃতিদাতা বিশিষ্ট নাগরিকদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। তাঁদের বিবৃতিতেও বলা হয়েছে `নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফেরাতে নির্বাচন কমিশন এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়`। প্রশ্ন হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর উপায় কী? সেই সমঝোতা বা জাতীয় ঐকমত্যের জন্য  রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার কোনো আগ্রহ ও আন্তরিকতা আছে কি? 


প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার শর্ত ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ঐকমত্য নির্বাচনের জন্য কতটা জ্রুরি, তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। এ সমঝোতার কারণেই গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হলেও ১৯৯৬সালের একতরফা নির্বাচন কলঙ্কচিহ্ন হয়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কোনো আইন তৈরি ছাড়াই রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অধীনে নির্বাচন মোটামুটি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিপরীতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যখনই মতানৈক্য হয়েছে, তখনই তা সমস্যার জন্ম দিয়েছে।  সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের কথায়, `ক্ষমতাসীন দলের গঠিত নির্বাচন কমিশন দ্বারা ও ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি`।২০০৬ সালের রাজনৈতিক সংকট এবং ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিরোধের মূলেও আছে রাজনৈতিক সমঝোতার তোয়াক্কা না করে একতরফা পদক্ষেপ গ্রহণ। আর সমঝোতার অর্থ যে শুধু আনুষ্ঠানিক সংলাপ নয়, পারস্পরিক আস্থা অর্জনের বিষয়, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। 


তা ছাড়া শুধু নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতাই কি আমাদের একমাত্র চাওয়া? দেশে আমরা কীধরণের গ্ণতন্ত্র চাই, সেটাও নির্ধারণ করা জরুরি। স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল কী হাইব্রিড গণতন্ত্র? রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার মত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীশাসিত ব্যবস্থা? সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য কি শুধু নির্বাহী বিভাগের কাজগুলো অনুমোদন করা? সংসদের কাছে মন্ত্রীদের জবাবদিহির আবশ্যকতার বিষয়েও কি সমঝোতার অবকাশ নেই?      


সাখাওয়াত হোসেন উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে যেসব সংস্কার হয়েছে, সেগুলোর নজির টেনে আমাদেরও আইন করার প্রয়োজনের কথা বলেছেন (উপমহাদেশের অভিজ্ঞতায় ইসি গঠনে নতুন ভাবনা, প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১)। তিনি লিখেছেন `বাংলাদেশে বর্তমান পদ্ধতিতে শাসক দলের প্রভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের পর থেকে যে বিতর্ক হচ্ছে, তা অবসানে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কমিশন গঠনে বিকল্প নেই`। কিন্তু কার্যকর বিরোধীদলহীন সংসদ, যেখানে অর্থবহ বিতর্কের কোনো নজির নেই, সেখানে ভারসাম্যহীন আইন তৈরির আশঙ্কাই কি প্রবল নয়? কথিত সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে একতরফা সিদ্ধান্ত আরোপের যে ঝুঁকি, তা যে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের মতামতও যে নাকচ হয়ে গিয়েছিল, তা নিশ্চয়ই আমরা বিস্মৃত হইনি। একতরফা সিদ্ধান্তের খেসারতই কি বর্তমান সংকটের কারণ নয়?   


এই পটভূমিতে মাহবুব তালুকদারের মন্তব্য `রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়` কথাটি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। নির্বাচন ব্যবস্থার সর্বনাশ সাধনের উন্য বিপুলভাবে স্মালোচিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও এখন সব দলের ঐকমত্যের কথা বলেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছেন, ন্তুন কমিশন হওয়া উচিত সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এসব বক্তব্য উপেক্ষণীয় নয়। নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনের দাবি বা আলোচনার আগে তাই রাজনৈতিক সমঝোতার কথাটিও বলা দরকার। অন্যথায় প্রত্যাশিত ফল না-ও মিলতে পারে এবং তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশিও হতে পারে। 


(৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো প্ত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime in N

একটি জরিপ, নৈরাশ্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন

উন্নত গণতন্ত্রে সরকার , সরকারপ্রধান, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এবং বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুতে প্রায়ই জনমত জরিপ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো সংবাদমাধ্যম, আবার কখনো বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব জরিপ করায়। বেশ কিছু পেশাদার জরিপকারী প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা শুধু জরিপের কাজ করে। এসব জরিপ আমাদের গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন ভোটের মতো নয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু সেই ওয়েবসাইটের নিয়মিত ব্যবহারকারীদের মতামত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রায় দুই দশক বার্ষিক জরিপে রাজনীতির গতিপ্রকৃতির চমৎকার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জরিপ করতে গেলে সরকারের সায় আছে কিনা সেটা দেখা হয়, নইলে পেশাদার বিশেষজ্ঞরা বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো ওই দায়িত্ব নিতে চান না। কথা বলার ভয়ের মতো মতামত জানতে চাওয়াতেও এক ধরনের ভয়ের আসর পড়েছে। গণতন্ত্র প্রসারে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট, আইআরআই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা এখনো মাঝে মধ্যে স্পর্শকাতর রাজন

ভিসা নিষেধাজ্ঞা গুরুতর, সাংবাদিক নির্যাতন কী

একই দিনের দুটি সংবাদ শিরোনাম, ’৯ মাসে ২১৭ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার: আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ’পিটার হাসের বক্তব্য স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর চাপ, সমাবেশে সাংবাদিকনেতারা’। দুটো খবরই সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে। তবে একটি খবর, যাতে আছে সেই সব সাংবাদিকদের কথা, যাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শারীরিক ক্ষতি অথবা গ্রেপ্তার ও মামলার কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন; আর অন্যটিতে ভবিষ্যতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী যুক্তরাষ্ট্র যেতে চাইলে ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি বা তাঁর যে সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা। সাংবাদিকদের নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে গবেষণার কাজ ও তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে একটি মানবাধিকার সংগঠন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার দুশ্চিন্তায় প্রতিবাদী হয়েছেন সাংবাদিকদের অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্লাটফর্ম জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট।  বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির মত অধিকার লংঘনের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তারই অংশ হিসাবে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতার ওপর তাদের আলাদা মনোযোগ। তাদের প্রকাশিত হিসাব