সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতিতে তারকাদের দায়

ই-অরেঞ্জ নামের একটি অনলাইন বাণিজ্য বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখন নানারকম অভিযোগ ও কেলেংকারির কথা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি গুলশান থানায় প্রায় রেকর্ড সময় চাকরি করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর সোহেল রানার বেনামি বিনিয়োগের একটি প্রকল্প বলেও জানা যাচ্ছে। অত্যন্ত প্রতাপশালী এই ইন্সপেক্টর কপালের ফেরে দেশান্তরি হওয়ার চেষ্টার সময়ে ভারতে আটক হয়েছেন। সাম্প্রতিক অন্যান্য আর্থিক কেলেংকারির মত ইন্সপেক্টর সোহেল রানার সহায়-সম্পদের সেসব বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। আমার লেখার বিষয় অবশ্য ওই আলাদিনের চেরাগের মালিক ইন্সপেক্টর নন, বা তাঁর বেনামি কোম্পানি ই-অরেঞ্জ নয়; ই-অরেঞ্জ এবং তার মত আরও যেসব অপরীক্ষিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে দেশের প্রতিষ্ঠিত তারকাদের ইমেজকে কাজে লাগায়, সেই তারকাদের উদ্দেশ্যে।        

 

মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারকারা খ্যাতি অর্জন করেন এবং জনমানসে তাঁদের যে ইমেজ বা ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে, তার সর্ব্বোচ্চ আর্থিক মূল্য আদায় ও ভোগ করা তাঁদের ন্যায্য অধিকার। সুতরাং তাঁরা বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে অথবা কোনো পণ্য, পরিসেবা বা ব্র্যান্ডের প্রচার-প্রসারে অংশ নিলে আপত্তির কিছু নেই, সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইনগত বাধাও নেই। ভোগ্যপণ্য বিপণনের নতুন অনলাইন প্লাটফর্ম  ই-অরেঞ্জ এবং ইভ্যালির মত প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আগ্রহ তৈরি ও ক্রেতা আকর্ষণের জন্য তাই বেশ কিছু জনপ্রিয় তারকার শরণাপন্ন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভালো-মন্দ ওইসব তারকা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করেছেন, তা বলা মুশকিল। তবে ই-অরেঞ্জের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা যে সুখকর নয়, সেটা তিনি ভালোই উপলব্ধি করেছেন। তাঁকে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা অনাকাংখিত। 

 

এধরণের ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বিজ্ঞাপনে মিথ্যাচার কিম্বা অসত্য তথ্য দিয়ে গ্রাহক বা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা অথবা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের প্রচার-প্রসারে অংশ নেওয়ার কারণে বহু তারকা সমালোচিত হয়েছেন। ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর ও আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণেই এখন আর কেউ বিড়ি, সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন না, কিম্বা শুভেচ্ছাদূত হন না। 

 

২০১৬ সালেই ভারতে ম্যাগি নুডলসের বিজ্ঞাপন করার জন্য অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিনতা ও মাধুরী দীক্ষিত ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েন। তখন ওই নুডলসে  ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল বলেই ভারতজুড়ে হইচই পড়ে যায়। ভারতের তখনকার আইনমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি তখন বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য বা দাবি করা পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন বা সেগুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনুমোদনকারী তারকার ব্যক্তিগত দায় নির্ধারণ ও সাজার বিধান করে আইন প্রস্তাব করেন ( সেলেবস কট ইন কন্ট্রোভার্সিস টু দেয়ার এন্দোর্সমেন্ট ডিলস। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১১ নভেম্বর ২০১৬)। একইসময়ে চীনে আইন ছিল, কোনো তারকা কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে চাইলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে সেই পণ্য ব্যবহার করে তার গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। 

 

ভারতে শেষপর্যন্ত ভোক্তা সুরক্ষা আইন ২০১৯ সালে পাস হয় এবং সেই আইনের ৮৯ ধারায় প্রস্তুতকারক এবং সেবা প্রদানকারীর মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনে ভোক্তার ক্ষতির জন্য দুই বছরের জেল ও ১০ লাখ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অপরাধের পুনরাবৃত্তির বেলায় প্রতিবারের জন্য সাজা বাড়বে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা ৫০ লাখ রুপি। 


বাংলাদেশের আইনটি ২০০৯ সালের। ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা আইন ২০০৯-`র ৪৪ ধারায় মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রতারণার সাজা একবছরের জেল কিম্বা সর্ব্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। ওই আইনে ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে একটি দপ্তরও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তারা এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ই-কমার্স নির্দেশিকা মেনে চলার নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে ভারত এবং বাংলাদেশের আইনে বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ ও পণ্য বা সেবা অনুমোদন অথবা সুপারিশের জন্য তারকাদের ব্যক্তিগত দায় নির্ধারণ করা নেই। সম্ভবত এ কারণেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা বা তার বর্ণিত গুণাগুণের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই ছাড়াই আমাদের তারকারা সেগুলোর প্রতিনিধিত্ব করায় রাজি হয়ে যান। অথচ এর কারণে যে তাঁরা নিজেদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেটি খেয়াল করেন না।

 

সমস্যাটি যে শুধু তারকাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা-ও নয়। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও এধরণের প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক উদ্যোগে ব্যবহৃত হতে পারে। যে ইভ্যালি এখন দেনার দায়ে ডুবতে বসেছে এবং হাজার হাজার ভোক্তা ও সরবরাহকারীকে অজানা ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের জাতীয় দলের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এর আগে ২০১২ সালে বিপিএল ক্রিকেটে টাইটেল স্পন্সর করেছিল কথিত পনজি স্কিম বা প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপ। 

 

দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার বিচারে জাতীয় দল কিম্বা লিগ টিমের লোগোতে যে কোনো কোম্পানির নাম সেই কোম্পানির প্রতি মানুষের আস্থা তৈরিতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চয়ই নতুন করে আলোচনার অবকাশ নেই। অনিচ্ছাকৃত হলেও এরকম প্রতারকদের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়ানোর জন্য প্রতারিত ভুক্তভোগীদের কাছে ক্রিকেট বোর্ড এবং ওই সব তারকা কেউ কখনো দুঃখপ্রকাশ করেছেন, এমন কোনো খবর আমাদের চখে পড়েনি। তাঁদের কি কোনোই দায় নেই। 

 

অসাধু ব্যবসায়ী বা কথিত উদ্যোক্তারা আমাদের আইনগত দূর্বলতা এবং আইন প্রয়োগে শৈথিল্য ও প্রশাসনের দূর্নীতির সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেসম্পর্কে খোঁজখবর ও প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামেন। ফলে একই ভুলের ফাঁদে আমরা বারবার পা দেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম পরিস্থিতি এড়ানোর উপায় কী? দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির প্রশ্নটি এখানে সবার আগে, কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সেই আলোচনা অর্থহীন। এক্ষেত্রে আমাদের তারকারা যদি কিছুটা সতর্ক হন, ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের প্রতি দায়িত্বশীল হন, তাহলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব। উচ্চ আদালত বিভিন্ন বিষয়ে যেভাবে স্বতপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন, সেরকম ভূমিকাও অবশ্য ভুক্তভোগীদের কষ্ট লাঘবে কাজে আসতে পারে। কথিত ভুমিদস্যুদের প্রতারণা থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে ভুঁইফোড় আবাস্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রকাশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার ক্তহা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। 

 

(১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)      

 

 

 

        


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...