সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কৃতিত্ব দাবি করলে দায় নেবেন না কেন

প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আমি বিভিন্ন অনলাইন ট্রাভেল কোম্পানির পোর্টাল থেকে টিকিট কিনি। এমিরেটস কিম্বা কাতার এয়ারওয়েজের ওয়েবসাইট থেকেও টিকিটের দাম যাচাই করে দেখেছি, অনলাইন ট্রাভেল কোম্পানিতে টিকিট তুলনামূলকভাবে সস্তায় পাওয়া যায়। এমনকি বিমানের ক্ষেত্রেও আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। হোটেল ভাড়ার ক্ষেত্রেও তা-ই। হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রতি রাতের জন্য কক্ষভাড়া যা চাওয়া হয়, হোটেলস ডটকম, কিম্বা বুকিং ডটকমে সেই একই কক্ষের ভাড়া তার থেকে অনেক কমে, এমনকি পঞ্চাশ শতাংশ কমে পাওয়া যায়। আমাজন থেকে গেল সপ্তাহেই একটি নিত্যব্যবহার্য জিনিস কিনেছি, যার দাম পড়েছে বাজারে তার নির্ধারিত খুচরা দরের অর্ধেক এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তা নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। যেসব কোম্পানির কথা বলছি, সেগুলোর অধিকাংশই বহুজাতিক কোম্পানি, তবে যেসব দেশে তারা ব্যবসা করে সেসব দেশে তাদের শাখা আছে এবং স্থানীয় আইন মেনে তাদের ব্যবসা করতে হয়। 


শুধু যে অনলাইন কোম্পানিগুলোই কম দামে পণ্য ও সেবা দেয়, তা নয়। প্রতিষ্ঠিত যেসব কোম্পানির বিভিন্ন শহরে প্রদর্শনীকেন্দ্র ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে, তারাও একইপণ্য অনলাইনে নিজস্ব দোকানের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে। অনলাইনের ব্যবসায় তাদের দোকানভাড়া, পরিচালনা এবং বিক্রয়কর্মীর বেতন-ভাতার কোনো খরচ নেই। বড় বড় গুদামঘরে অটোমেশনের কারণে স্বল্পসংখ্যক কর্মী দিয়েই ক্রয় আদেশ, প্যাকেজিং ও পণ্য বিতরণের কাজগুলো করানো সম্ভব হয় বলেই দোকানের চেয়ে অনলাইনে একই জিনিস অনেক কম দামে বিক্রি করেও তারা মুনাফা করে। 


একইভাবে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর আগে প্রতিটি শহরে শাখা ছিল, এখন ই-ট্রাভেল কোম্পানির অনলাইনের ব্যবসা সামলাতে স্বল্পসংখ্যক কর্মী আর ছোট একটি অফিসেই কাজ হচ্ছে। অনলাইন কোম্পানিগুলো উৎপাদকের কাছ থেকে যখন পণ্য কেনে, তখন তারা অন্যান্য ছোট ও মাঝারি দোকানের চেয়ে কয়েকগুণ পণ্য একসঙ্গে কিনতে পারে। তাই তারা পাইকারি দামেও বড়ধরণের ছাড় আদায় করতে পারে। সুতরাং তারা সাধারণ ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রির  সময়ে বড় ধরণের ছাড় দিতে পারবে সেটাই তো স্বাভাবিক। 


ই-বাণিজ্যের ধারণা এবং চল - কোনোটাই নতুন নয়, বাংলাদেশে বরং এটি শুরু হয়েছে একটু দেরিতে। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে এধরণের বাণিজ্যব্যবস্থার কোনো প্রস্তুতিই নেওয়া হয়নি। ই-বাণিজ্যের সুবিধা নিতে মানুষ কেন টাকা দিয়েছে, সে জন্য প্রতারিত ভোক্তা নানাধরণের অশ্রাব্য গালি শুনছেন। এ গঞ্জনা যে শুধু পরিবারের সদস্য বা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনছেন, তা-ই নয়, এমনকি খোদ প্রতারকও ভোক্তাকে দায়ী করে বলছে মানুষের অতিরিক্ত লোভের কারণেই নাকি ই-বাণিজ্যের এ অবস্থা। আনন্দের বাজারের এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহমুদুল হক খন্দকার পলাতক অবস্থায় ফেসবুক লাইভে বলেছেন, ‘আপনারা কেন ছাড়ে পণ্য নেন? কেন মোটরসাইকেল, ফ্রিজ নেন ছাড়ে? কেন ছাড় ছাড়া মাল কেনেন না? গ্রাহকেরা লোভী। তাঁদের কারণেই আজ এই অবস্থা` (গ্রাহকদেরই লোভী বললেন পলাতক ‘আনন্দের বাজার’–এর এমডি, প্রথম আলো, ৯ অক্টোবর, ২০২১)। 


অবশ্য তার আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, গ্রাহকরা কম দামে পণ্য কিনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, গ্রাহকের ক্ষতির দায় সরকার নেবে কেন? বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার অর্থনীতিতে আছেন, নাকি নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে আছেন, বোঝা দায়। বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক পণ্যমূল্যের বদলে তাহলে তো তাঁর মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দামেই সবকিছু বিক্রি হওয়ার কথা? বাজারে যে এখন সব জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, তেমনটি তো তাহলে হওয়ার কথা নয়।        


ইভ্যালির প্রতারণার খোলস খসে পড়া থেকে যে কাহিনির শুরু, তাতে এখন পর্যন্ত ডজনখানেকের বেশি কথিত ই-উদ্যোক্তার প্রতারণা প্রকাশ পেয়েছে। সব ক্ষেত্রেই গল্পটা একই। চটকদার ছাড়ে নানাধরণের পণ্য ও সেবা বিক্রির বিজ্ঞাপনে ভোক্তারা সরল বিশ্বাসে টাকা দিয়ে প্রতিশ্রুত পণ্যের আশায় বসে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করেছেন, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা গ্রাহকসেবার নম্বরে ফোন করে ফল না পেয়ে অফিস কামাই করে কোম্পানির অফিসে গিয়ে তাদের আসল পরিচয় টের পেয়েছেন। 


অনলাইনে টাকা দেওয়ার সময়ে তাঁরা যৌক্তিকভাবেই ভেবেছেন, দেশে তো ব্যবসা-বাণিজ্যের আইন আছে, ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষ্ণের আলাদা দপ্তর আছে, সরকার আছে। সরকার অনুমোদিত লেনদেন ব্যবস্থায় তাঁরা টাকাও দিয়েছেন ডিজিটালি - অনলাইন ব্যাংকিং অথবা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থায়; কাঁচাবাজারে যেভাবে ব্যাগে ভরে নগদ নিয়ে সদাই করতে হয়, সেরকম সেকেলে কোনো ব্যবস্থায় নয়। 


অন্যান্য দেশে যেসব ব্যাংক বা কোম্পানি ক্রেডিট কার্ডের কারবার করে, তাদের আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। গ্রাহক কার্ডের মাধ্যমে কেনা জিনিস না পেলে, কিম্বা গুণগত মানে সন্তুষ্ট না হলে সেটি ফেরত পাঠানোয় জটিলতা হলে ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে জানালে গ্রাহক টাকা ফেরত পান। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি পরে ওই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন সমন্বয় করে নেয়। ফলে অনলাইন বিক্রেতা প্রতারণার সুযোগ পায় না এবং গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। 


২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ রকম একটি ব্যবস্থা `এসক্রো সেবা’ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যাতে গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তার আগে টাকা জমা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের কাছে। সেই নির্দেশনা গত দুই বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি বলেই জানা যাচ্ছে। আবার ইভ্যালির ক্ষেত্রে  জানা যাচ্ছে আরও চমকপ্রদ, কিন্তু অতীব রহস্যজনক তথ্য। সংবাদপ্ত্রের অনুসন্ধানে যখন জানা গেল পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে যে ব্যবসা তারা করছে, তাতে মানি-লন্ডারিং ঘটছে বলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তখন তাদের সব ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করে দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কিন্তু ইভ্যালির লেনদেনের বিস্তারিত অনুসন্ধান না করেই তাদের ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয় এবং অনিয়মের খোঁজ মেলে আট মাস পর । এসময়ে প্রতারিত হন আরও হাজার হাজার গ্রাহক ( কার ইশারায় ইভ্যালির স্থগিত ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছিল?, প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০২১)। 

  

এতগুলো প্রতারণার ঘটনায় প্রমাণ হচ্ছে অনলাইন ব্যবসার জন্য দেশে উপযুক্ত আইন, তদারকি ব্যবস্থা, প্রতিকার - এগুলোর কিছুই নেই। সরকার আছে, তবে দায় অস্বীকারের জন্য। বাণিজ্যমন্ত্রী যদিও বলেছেন যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কাজ করছে। বিষয়টি যেন এমন যে প্রতারকের বিচার করলেই গ্রাহকের দুঃখমোচন হবে। সরকারের তাড়া আছে দেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসাবে দেখানোর। সুতরাং ই-উদ্যোক্তা বানানোর জন্য নানারকম প্রণোদনাও আছে। অল্পদিনেই ই-বাণিজ্যের যে প্রসার ঘটেছে তার কৃতিত্ব কার, প্রশ্ন করারও প্রয়োজন নেই। এর একমাত্র দাবিদার সরকার। কিন্তু আইনের দূর্বলতা ও তদারকির অভাবে ই-বাণিজ্য যখন সীমাহীন প্রতারণার হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তখন দায় নিরীহ ক্রেতার। এত দিন ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষকে এরকম দোষারোপের ব্যাপারটা ছিল শুধু শেয়ারবাজারে। এখন সবকিছুতেই দোষ শুধু কথিত পাবলিকের। এখন যারাই কর্তৃপক্ষ, তারাই মনে হয় দায় অস্বীকারের সংস্কৃতিকে বেশ রপ্ত করে নিয়েছেন।


(১৪ অক্টোবর, ২০২১-`র প্রথম আলো প্ত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...