বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক এবং নাগরিক অধিকার কর্মীর দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তাঁদের মোবাইলফোনে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিতে পেগাসাস নামের একটি স্পাইওয়্যার বেআইনীভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। পেগাসাস ইজরায়েলি প্রতিষ্ঠান সাইবার আর্মস সংস্থা (এনসও) গ্রুপ দ্বারা উদ্ভাবিত একটি সাইবার-অস্ত্র যা যেকোনো ব্যাক্তির স্মার্টফোন হ্যাক করে এতে থাকা তথ্য বের করে নেওয়া ছাড়াও ফোনের মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম। নজরদারির শিকার এসব ব্যক্তি প্রকাশিত খবরের সত্যতা জানার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন।
নরেন্দ্র মোদির সরকার পেগাসাস কেনা বা ব্যবহারের সত্যতা স্বীকার করেনি। তবে অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজেরাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন, যে কমিটির নেতৃত্ব দেবেন একজন সাবেক বিচারপতি। আদালতের গঠন করা কমিটিতে তিনজন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ থাকবেন এবং দুই মাসের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সরকারের প্রস্তাব নাকচ করার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা এ কথাও বলেছেন যে সরকারকে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের অনুমতি দিলে তা ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী হতো। কোনো নাগরিক সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার বা বেআইনী কাজের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পর সরকারের তদন্ত যে পক্ষপাতমূলক হতে পারে, এই স্বীকৃতির বিচারিক মূল্য অনেক।
সরকারের দাখিল করা হলফনামায় তাদের হাতে পেগাসাস থাকার সত্যতা সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। শুনানির সময় সরকারের পক্ষ থেকে শুধু বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা বলা যাবে না। কেননা, তাতে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করা হবে। আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আদালত হস্তক্ষেপ করতে চান না। কিন্তু তাই বলে নীরব দর্শক সেজেও থাকতে পারেন না।
আমাদের উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থায় আইনকানুন, রীতিনীতি প্রায় অভিন্ন। ভারতের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও রায়গুলো উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও নজির হিসাবে অনুসৃত হয়। তাই আমরা আশ্বান্বিত হতে পারি যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আদালতও একই রকম নীতি অনুসরণ করবেন। ফোন হ্যাকিংয়ের প্রসার আমাদের দেশে যে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। ভুক্তভোগীরা সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হলে ভারতের এই দৃষ্টান্ত তাঁদের সহায়ক হতে পারে। যদিও এর আগে কয়েকজন আইনজীবি জনস্বার্থে এবিষয়ে চেষ্টা করে বেশি দূর এগুতে পারেননি।
বিচারব্যাবস্থা নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেও অবশ্য আমাদের দেশেও মাঝে-মধ্যে আশা জাগানো রায় বা নির্দেশনা দেখা যায়। অভিনেত্রী পরীমনির জামিনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এরকম পদক্ষেপ হলো রিমান্ডের অপব্যবহার বিষয়ক পর্যবেক্ষণ। যেহেতু বিষয়টি এখনো বিচারাধীন, তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা বাড়ানো হয়তো সমীচিন হবে না।
তবে অপেক্ষাকৃত কম. আলোচিত ঝিনাইদহের একটি মামলার কথা না বললেই নয়। ২ অক্টোবর ঝিনাইদহের একটি আদালত মোবাইল টেলিফোনে সরকারি কর্মকর্তার অন্যায় অনুপ্রবেশ ও একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। সরকারি কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার এক ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়েছেন ঝিনাইদহের ওই আদালত। আদালত বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই একজন নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না।
মামলার বিবরণে জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিজুল হক, গত ২ আগস্ট ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বাস চালককে মারধর করলে সেই ঘটনার কিছু ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ব্যক্তিগত গ্রুপে এগুলো শেয়ার করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৭ বছর বয়সী ওই যুবককে আটক করেন,, তাঁর ফোন জব্দ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং ন্যায়বিচারে বাধাসহ জামিন অযোগ্য সবগুলো অপরাধেরই অভিযোগ করা হয়। ফলে জামিন পাওয়ার আগে তাঁকে তিন সপ্তাহ জেলে থাকতে হয় ।
জামিন শুনানির সময় জেলা ও দায়রা জজ মো. শওকত হোসেন বলেন, `একজন নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না, এমনকি যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে তখনও নয়` (‘সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারেন না’, বাংলা ট্রিবিউন, ২ অক্টোবর, ২০২১)। বিচারক বলেন, একজন সরকারি কর্মচারী, যেমন ইউএনও, নাগরিকের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করার এবং তার ব্যক্তিগত বার্তা পড়ার অধিকার রাখেন না। আজিজুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে `ভুল` আখ্যা দিয়ে আদালত জানান, এগুলো সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। মামলা করার আগে পুলিশের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা উচিত ছিল। মানহানি এবং ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ এখানে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, হোয়াটসঅ্যাপের বার্তাগুলো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্ট করা। যা শুধুমাত্র প্রেরক এবং প্রাপকরাই সেগুলো দেখতে পারেন এবং এই ধরনের কথোপকথনে কারো বদনাম হতে পারে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের কারণে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে এবং টেলিফোন ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের যোগাযোগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ঝুঁকি লক্ষ্ণীয়ভাবে বেড়েছে, সেহেতু ঝিনাইদহের এই রায় নিঃসন্দেহে ,উৎসাহজনক। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সরকারের সমালোচকদের হেনস্তা ও হয়রানির জন্য এই আইন এবং জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত যখন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তখন আদালত নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে, সেটাই তো প্রত্যাশিত।
(৩০ অক্টোবর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন