সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নাগরিকদের সুরক্ষায় আদালত ভরসা হয়ে উঠুক

 ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এক যুগান্তকারী নজির গড়েছেন।  সাংবাদিক, কর্মী এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর নজরদারির জন্য সরকার বেআইনীভাবে বিতর্কিত পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে কি না, তা নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। `জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগ উত্থাপন করে রাষ্ট্র সবসময়ে পার পেতে পারে না`বলে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। বিচারপতিরা বলেছেন, নির্বিচারে গুপ্তচরবৃত্তির অনুমতি দেওয়া যায় না, যা বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর ভীতিকর প্রভাব ফেলতে পারে । 

বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক এবং নাগরিক অধিকার কর্মীর দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তাঁদের  মোবাইলফোনে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিতে পেগাসাস নামের একটি স্পাইওয়্যার বেআইনীভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।  পেগাসাস  ইজরায়েলি প্রতিষ্ঠান সাইবার আর্মস সংস্থা (এনসও) গ্রুপ দ্বারা উদ্ভাবিত একটি সাইবার-অস্ত্র যা যেকোনো ব্যাক্তির স্মার্টফোন হ্যাক করে এতে থাকা তথ্য বের করে নেওয়া ছাড়াও ফোনের মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম। নজরদারির শিকার এসব ব্যক্তি প্রকাশিত খবরের সত্যতা জানার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন। 

নরেন্দ্র মোদির সরকার পেগাসাস কেনা বা ব্যবহারের সত্যতা স্বীকার করেনি। তবে অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজেরাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন, যে কমিটির নেতৃত্ব দেবেন একজন সাবেক বিচারপতি। আদালতের গঠন করা কমিটিতে তিনজন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ থাকবেন এবং দুই মাসের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সরকারের প্রস্তাব নাকচ করার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা এ কথাও বলেছেন যে সরকারকে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের অনুমতি দিলে তা ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী হতো। কোনো নাগরিক সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার বা বেআইনী কাজের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পর সরকারের তদন্ত যে পক্ষপাতমূলক হতে পারে, এই স্বীকৃতির বিচারিক মূল্য অনেক।  


সরকারের দাখিল করা হলফনামায় তাদের হাতে পেগাসাস থাকার সত্যতা সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। শুনানির সময় সরকারের পক্ষ থেকে শুধু বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা বলা যাবে না। কেননা, তাতে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করা হবে। আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আদালত হস্তক্ষেপ করতে চান না। কিন্তু তাই বলে নীরব দর্শক সেজেও থাকতে পারেন না। 


আমাদের উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থায় আইনকানুন, রীতিনীতি প্রায় অভিন্ন। ভারতের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও রায়গুলো উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও নজির হিসাবে অনুসৃত হয়। তাই আমরা আশ্বান্বিত হতে পারি যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আদালতও একই রকম নীতি অনুসরণ করবেন। ফোন হ্যাকিংয়ের প্রসার আমাদের দেশে যে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। ভুক্তভোগীরা সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হলে ভারতের এই দৃষ্টান্ত তাঁদের সহায়ক হতে পারে। যদিও এর আগে কয়েকজন আইনজীবি জনস্বার্থে এবিষয়ে চেষ্টা করে বেশি দূর এগুতে পারেননি।    


বিচারব্যাবস্থা নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেও অবশ্য আমাদের দেশেও মাঝে-মধ্যে আশা জাগানো রায় বা নির্দেশনা দেখা যায়। অভিনেত্রী পরীমনির জামিনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এরকম পদক্ষেপ হলো রিমান্ডের অপব্যবহার বিষয়ক পর্যবেক্ষণ। যেহেতু বিষয়টি এখনো বিচারাধীন, তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা বাড়ানো হয়তো সমীচিন হবে না। 


তবে অপেক্ষাকৃত কম. আলোচিত ঝিনাইদহের একটি মামলার কথা না বললেই নয়। ২ অক্টোবর ঝিনাইদহের একটি আদালত মোবাইল টেলিফোনে সরকারি কর্মকর্তার অন্যায় অনুপ্রবেশ ও একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। সরকারি কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার এক ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়েছেন ঝিনাইদহের ওই আদালত। আদালত বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই একজন নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না। 


মামলার বিবরণে জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিজুল হক, গত ২ আগস্ট ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বাস চালককে মারধর করলে সেই ঘটনার কিছু ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ব্যক্তিগত গ্রুপে এগুলো শেয়ার করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৭ বছর বয়সী ওই যুবককে আটক করেন,, তাঁর ফোন জব্দ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং ন্যায়বিচারে বাধাসহ জামিন অযোগ্য সবগুলো অপরাধেরই অভিযোগ করা হয়। ফলে জামিন পাওয়ার আগে তাঁকে তিন সপ্তাহ জেলে থাকতে হয় ।


জামিন শুনানির সময় জেলা ও দায়রা জজ মো. শওকত হোসেন বলেন, `একজন নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না, এমনকি যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে তখনও নয়` (‘সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারেন না’, বাংলা ট্রিবিউন, ২ অক্টোবর, ২০২১)। বিচারক বলেন, একজন সরকারি কর্মচারী, যেমন ইউএনও, নাগরিকের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করার এবং তার ব্যক্তিগত বার্তা পড়ার অধিকার রাখেন না। আজিজুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে `ভুল` আখ্যা দিয়ে আদালত জানান, এগুলো সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। মামলা করার আগে পুলিশের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা উচিত ছিল। মানহানি এবং ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ এখানে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন,  হোয়াটসঅ্যাপের বার্তাগুলো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্ট করা। যা শুধুমাত্র প্রেরক এবং প্রাপকরাই সেগুলো দেখতে পারেন এবং এই ধরনের কথোপকথনে কারো বদনাম হতে পারে না। 


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের কারণে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে এবং টেলিফোন ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের যোগাযোগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ঝুঁকি লক্ষ্ণীয়ভাবে বেড়েছে, সেহেতু ঝিনাইদহের এই রায় নিঃসন্দেহে ,উৎসাহজনক। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সরকারের সমালোচকদের হেনস্তা ও হয়রানির জন্য এই আইন এবং জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত যখন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তখন আদালত নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে, সেটাই তো প্রত্যাশিত। 

(৩০ অক্টোবর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...