সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ডিজিটাল আইন প্রয়োগে `বিশেষ ছাড়`, পুরোপুরি বাতিল নয় কেন?

`ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিককে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার নয়: আইনমন্ত্রী` শিরোনামে ৩০ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঘিরে চলমান বিতর্কের আলোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ-আপত্তি উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি এই আইনটি পাশ করা হয়। আপত্তিগুলো যে অমূলক ছিল না, তা আইনটির বহুল অপপ্রয়োগে ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে। 


আইনমন্ত্রী কথাগুলো যাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তাঁরা ওভারসিজ করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ওকাব)-এর সদস্য। অর্থাৎ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তিনি বিদেশিদের কাছেও আইনের বিষয়ে কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন। এই আইনটির বিষয়ে বিদেশিরা বিশেষত পাশ্চাত্যের দেশগুলো এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সরকারের কাছে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে।  


ওকাবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে সতর্ক সাধুবাদও জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের জন্য তিনি কিছুটা ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানোর কারণেই তাঁকে তাঁরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। 


কিন্তু দুঃখজনক কথা হচ্ছে, তাঁর ঘোষিত সিদ্ধান্ত আরও বেশি উদ্বেগজনক। কেন উদ্বেগজনক, তা ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর মন্তব্যগুলো দেখে নেওয়া দরকার। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সমন দিতে হবে। মামলা হওয়ার পর সাংবাদিক আদালতে জামিন চাওয়ার সুযোগ পাবেন। তাঁর এই কথাগুলো আইনে নেই। সুতরাং, সাংবাদিকদের এই সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। যেটা তাঁরা না-ও করতে পারেন। অর্থাৎ, কাগজে-কলমে পরিবর্তন ছাড়া মৌখিক আশ্বাস চটকদার শিরোনামের জন্য ভালো, কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হওয়া যায় না। এই আইনের বিষয়ে সম্পাদক পরিষদকে তিন মন্ত্রী মিলে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা পূরণ না হওয়ার পর নতুন মৌখিক আশ্বাস বিশ্বাস করা যায় কি? 


বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় অফিস আদেশ জারি করার বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী যে জবাব দিয়েছেন, সেই বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘এ নির্দেশনা আমরা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে দিতে পারি না। যেটা করা হচ্ছে, তা হলো পুলিশ যেখানে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে ইন্টারনালি প্রতিটি থানাতে এ রকম জানানো হয়েছে বলে আমার কাছে খবর আছে।’ 


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আলোচনা করার কথা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দুজনে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন যদি কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাৎক্ষণিক সেই মামলা আদালতে গ্রহণ করে আদালত এর প্রসিডিউর শুরু করবেন না। আরেকটা আইন আছে আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬, সেখানে একটি সেল আছে, যারা তদন্ত করতে পারে যে মামলাটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয় কি না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলা হবে, তাৎক্ষণিকভাবে সেটা সেই সেলে যাবে। সেই সেলের তদন্তের পর যদি সাব্যস্ত হয় এই যে হ্যাঁ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অপরাধে নালিশ করা হয়েছে, তাতে সেই অপরাধের ইনগ্রেডিয়েন্টস (উপাদান) এই নালিশের মধ্যে আছে, তাইলেই মামলাটা নেওয়া হবে।’ 


স্বভাবতঃই প্রশ্ন ওঠে আইন প্রয়োগের বিষয়টি কি তাহলে মন্ত্রীদের ইচ্ছাধীন? আইনে যা-ই থাকুক না কেন, মন্ত্রীরা চাইলেই তাতে ব্যাতিক্রম ঘটাতে পারেন - এধরণের ব্যবস্থা দেশের আইনের শাসন সম্পর্কে দেশে-বিদেশে কী ধারণা তৈরি করবে? সাংবাদিক ছাড়া অন্যান্যদের জন্য তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার ও জামিনের সুযোগ না থাকার ব্যাপারটি আইন প্রয়োগে দুই রকম নীতি অনুসরণের শামিল। এটি শুধু যে সংবিধান পরিপন্থী তা-ই নয়, আইনের মৌলনীতি সবাইকে সমানভাবে দেখার বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন। 


সাংবাদিক হিসাবে আইনমন্ত্রীর ঘোষণায় বিশেষ সুবিধাভোগী হওয়ার সম্ভাবনার কারণে এ বিষয়ে চুপ থাকা অনেকের কাছে শ্রেয় মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু, তাঁদের জন্য ছোট্ট একটি সাবধানবাণী হচ্ছে, বিশেষ সুবিধাটুকু কিন্তু পুরোটাই সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল। সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি অংশের নেতা রুহুল আমিন গাজী ডিজিটাল আইনে এখনো জেলে আছেন। জামিন পান নি। জামাল মীর ১৮ মাস জেলে থাকার পর গত অক্টোবরে জামিন পেয়েছেন। রংপুরে সাংবাদিকদের দলাদলির শিকার আফরোজা বেগম প্রতিদ্বন্দ্বীদের মামলায় হয়রান হচ্ছেন। 


মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন, আর্টিকেল নাইন্টিনের সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে , ২০২১ সালে অন্তত ১৫জন সাংবাদিক এই আইনে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন এবং জেল খেটেছেন। গতবছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে এই আইনে মামলা হয়েছে অন্তত ২২৫ জনের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে ৬৮জনই সাংবাদিক। সাংবাদিকেরা সরকারের কাছ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধা নিতে চান না; কেননা তাতে ব্যাক্তি হিসাবে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণেই সরকারের মর্জিমাফিক বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং, প্রয়োজন যেকোনো আইনে সাংবাদিকতার পেশাগত অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।  

  

প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, আইনমন্ত্রী স্বীকার করেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছুটা অপব্যবহার ও কিছুটা দুর্ব্যবহার হয়েছে বলে  । তিনি বলেন, এর কারণে একটা ধারণা জন্মেছে যে এই আইন বাক্‌ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার রোধ করতে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই আইন এর কোনোটাকেই বন্ধ বা বাদ দেওয়ার জন্য করা হয়নি। আইনটি যদি বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বন্ধের জন্য না-ও হয়ে থাকে, তাহলে বাস্তবে সেটাই ঘটছে, যাকে তিনি কিছুটা অপব্যবহার বলে মেনে নিয়েছেন। আইন তো হয় অপরাধ দমনের জন্য, অপব্যবহারের জন্য নয়। যেহেতু এর অপব্যবহার এখন প্রমাণিত, সেহেতু তার সমাধান একটাই - আইনটি বাতিল করা। 


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের ভুক্তভোগী শুধু সাংবাদিকেরা নন, বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও এর ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এই আইনে আটক অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে লেখক মুস্তাক আহমেদের। নিগৃহীত হয়েছে বহু সাধারণ মানুষ। শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের কারণে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই আইন। সুতরাং এটি বাতিল করাই শ্রেয়। বরং সাইবার অপরাধ দমনে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে এমন আইন করা দরকার যাতে নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। 


(১ জানুয়ারি, ২০২২-এর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...