নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ও নাটকীয়তার যেন কোন শেষ নেই। মন্ত্রিপরিষদ সচিব যেমনটি বলেছিলেন যে ‘আশা করা যায়, এই আইন চূড়ান্ত হতে বেশি সময় লাগবে না’, ঠিক তেমনটিই ঘটছে। ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রীসভার বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনের খসড়া অনুমোদিত হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে সাংবাদিকেরা যখন জানতে চাইলেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি এই আইনের অধীনে হবে, তখন তিনি ওই জবাব দেন। বিলটি সংসদে উত্থাপিত হলো ২৩ জানুয়ারি এবং তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়ে পাঠানো হলো আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে। অতীব কর্মঠ কমিটি ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আইনের ভালো-মন্দ নিরীক্ষা করে দুটি ধারায় সামান্য পরিবর্তনের সুপারিশ করে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। তারা চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ কিম্বা নাগরিক গোষ্ঠীর মতামত নিতে পারত। কিন্তু সেই প্রয়োজন বোধ করেনি। অচিরেই যে এটি আইন হিসাবে গৃহীত হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আইনটি তৈরি ও অনুমোদনের প্রক্রিয়াকে তড়িঘড়ি ছাড়া অন্য কিছু বলা চলে না। আর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে এমন তড়িঘড়ির কোনো যুক্তি নেই।
সংসদে আইন তৈরির এই নাটকীয়তায় আমরা অবশ্য ভুলতে বসেছি যে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অযথাই হয়রানি করা হলো। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী এই পদের প্রতি কি কিছুটা অন্যায় করা হলো না? ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তিনি পালা করে রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেন, যদিও অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মিত্র অথবা বিশেষ নৈকট্যের অধিকারী। রাষ্ট্রপতির আলোচনার আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবং বামপন্থী দলগুলোর অধিকাংশই যোগ দেয় নি।
যাঁরা আলোচনায় অংশ নেননি, তাঁদের যুক্তি ছিল, এর আগেও কমিশন গঠনের সময়ে রাষ্ট্রপতি তাঁদের আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা যেসব সুপারিশ ও দাবি জানিয়েছিলেন, তার কোনোটিই রাখা হয় নি। নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয়দের অনেকেই ওই উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছিলেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপ খুব একটা কাজে দেবে না`।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তখন বললেন, `আমি আপনাদের বলব এ সংলাপ ব্যর্থ হচ্ছে নাকি সফল হচ্ছে, তা সংলাপ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি কী পদক্ষেপ নেন সেটা দেখার পর আপনারা বুঝবেন`। রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও তার ফলাফল যে সরকারের, মানে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল, তার আরও একটি অনাকাংখিত নজির আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। অথচ, রাষ্ট্রপতি যদি সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে সব দলের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন, তাহলে ফলাফল ভিন্ন কিছুও হলেও হতে পারত। কোনো দলের পক্ষেই তা বর্জন যৌক্তিক হতো না, এবং কমিশন গঠনের নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচির কারণে রাষ্ট্রপতিকে এমন বিব্রতকর অক্ষমতার মুখোমুখি হতে হতো না।
এখন যে আইন প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতেও এমন একটি ধারা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতির পদ একটি অনাকাংখিত বিতর্কের মুখে পড়তে পারে। `অতীতে অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলী এবং অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না` - বলে যে ধারা সংযোজন করা হয়েছে, তাতে কার্যত রাষ্ট্রপতির জন্য কি দায়মুক্তি চাওয়া হচ্ছে না? কেননা, অনুসন্ধান কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো কমিশনের নিয়োগকারী হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৫১(১) ধারায় রাষ্ট্রপতিকে দায়মুক্তি দেওয়ার সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও কেন এই নতুন আইনের নতুন দায়মুক্তির প্রস্তাব?
সংসদে উত্থাপিত আইনের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণ নানা মাধ্যমে তুলে ধরেছে। এসব আলোচনায় স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কেউ এই খসড়াকে সমর্থন করছে না। তাঁদের ভাষ্য, যে পদ্ধতিতে রকিব কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন গঠিত হয়েছে, এই খসড়া হচ্ছে সেই পরীক্ষিত ব্যর্থ পদ্ধতিকে আইনগত মোড়ক পরিয়ে বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। আইনটিতে বড়ধরণের পরিবর্তন না আনা হলে প্রমাণ হবে গত ২ জানুয়ারি আমাদের আইনমন্ত্রী যে `সর্বজনীন আইন` তৈরির আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা আসলে ছিল কথার কথা। তিনি বলেছিলেন, `এই আইনটা এমন একটা আইন হওয়া উচিত, যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। শুধু এক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তো এটা সর্বজনীন আইন হলো না`।
প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সংসদে কি সর্বজনীন আইন তৈরি সম্ভব? বিশেষ করে যে সংসদে মাত্র ৯ জন (বিএনপি ৭ + গণফোরাম ২) ছাড়া বাকি সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোট শরীক। সংসদীয় বিরোধীদল যেটি আছে, তারা যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করেছিল এবং সরকারের অংশ হওয়ার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ সত্ত্বেও বিরোধী আসনে বসতে বাধ্য হয়েছে, সেকথা নিশ্চয়ই কাউকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সংসদের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখনও বিএনপিই। ফলে `সর্বজনীন আইন` করতে হলে প্রয়োজন বিএনপির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। সেরকম কোনো কিছুতে ক্ষমতাসীন দল যে আগ্রহী হবে, তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে সরকারের লক্ষ্য ছিল নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা। তাই নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীদের সঙ্গে সংলাপে বসেছিলেন। এরপর নির্বাচনে মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ না পেলেও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দিতায় শরীক হওয়ায় তাকে অন্তত অংশগ্রহণমূলক বলে আওয়ামী লীগ দাবি করতে পেরেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের দৈন্যদশায় কোনো হেরফের হয়নি। ফলে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের জন্য সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে। গত ১৩ বছরে ক্ষমতার অংশীদার হয়েও যেসব দল নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা ও তাগিদ অনুভব করেনি, তারাও হঠাৎ করে আইনের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে এখন যাঁরা প্রশ্ন করছেন, তাঁদের সন্দেহ মোটেও অমূলক নয়। কোনোধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া শুধু কমিশন গঠনের আইন সুষ্ঠু নির্বাচনের মহৌষধ নয়। একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে উপযুক্ত কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তিনি চাইলে সেই প্রক্রিয়াকে সম্প্রসারণ করে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোসহ একটি প্রকৃত সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ হয়তো নিতে পারতেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ পদে দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে এমন একটি উদ্যোগ খুব বেশি একটা ঝুঁকিপূর্ণ হতো বলে মনে হয়না। তবে ইতিহাস আমাদের আশাবাদী করে না।
(২৭ জানুয়ারি, ২০২২-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন