সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

লবিংয়ের সব তথ্যই প্রকাশ করা হোক

বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিদেশে কোটি কোটি টাকা খরচের তথ্য প্রকাশ করায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে ধন্যবাদ জানানোর কথা ভেবেছিলাম। লবিং বা তদবির বাবদ এসব অর্থ খরচ হয়েছে। কিন্তু সংসদে তাঁর সোমবারের বক্তব্যের যে বিবরণ সংবাদপত্রে পাওয়া গেল তাতে তাঁকে সেই ধন্যবাদ জানানো গেল না বলে দুঃখিত। সংসদে অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে বরং তিনি নতুন কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। আর সংসদের বক্তব্য দেওয়ার পর ২৪ ঘন্টা না পেরোতেই তিনি সাংবাদিকদের কাছে বিরোধীদল বিএনপির লবিংয়ের খরচের আরেকটি নতুন অংক প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি লিখে এসব টাকার উৎস ও লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত করতে বলবে।


পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলেছেন তিন বছরে বিএনপি দুই মিলিয়ন ( ২০ লাখ) মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) খরচ করেছে । কিন্তু গতকাল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন বিএনপির খরচের পরিমাণ ৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ( সাড়ে ৩৭ লাখ) ডলার (৩২ কোয়ি টাকার বেশি। মনে হচ্ছে বিএনপির খরচের হিসাবটাও তাঁর কাছে ঠিকমত নেই। বিএনপি বেআইনিভাবে দেশের থেকে টাকা বিদেশে পাঠিয়ে থাকলে তা অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিৎ। আর বিদেশে লবিংয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণের দাবিও বিএনপির কাছে জানানো যায়। 


কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশে লবিংয়ের শুরুটা কবে ও কারা করেছে? সরকার যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রচারের জন্য প্রতি বছর লবিস্টের পিছনে অন্তত ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার (আনুমানিক পৌনে তিন কোটি টাকা) করে খরচ করছে, তার যৌক্তিকতা কী? তার চেয়েও বড় কথা বিষয়টি নিয়ে এতো গোপনীয়তা কেন? 


পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গত ৫ জানুয়ারি র‍্যাব ও বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে যে আলোচনা হয়, সেখানে কমিটির সদস্যরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করার আহবান জানালেন, তখন কেন তাঁদের বলা হয়নি যে ২০১৪ সাল থেকেই সরকার সেখানে লবিস্ট নিয়োগ করে রেখেছে? যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের পক্ষে লবিস্ট কাজ করেছে মর্মে সংবাদ প্রকাশের পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তা স্বীকার করে নিয়ে বললেন, সরকার প্রয়োজন মত ব্যবস্থা নেবে। 


আমরা এখন জানি, নিয়মিত চুক্তিতে কাজ করা লবিস্ট বিজিআর ছাড়াও গত বছর সেপ্টেম্বরে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক আয়োজন ও সফর বিনিময়ের লক্ষ্যে এক মাসের জন্য ৪০ হাজার ডলার ফিতে নিয়োগ করা হয়েছিল আরেকটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠান ফ্রিডল্যান্ডারকে। সংসদীয় কমিটির ওই সভায় প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী দুজনেই অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা কি তখন এই লবিস্টের কথা জানতেন না? তাঁরা তথ্যটি না জেনে থাকলে প্রমাণ হয় যে পররাষ্ট্র দপ্তর আসলে চালান কূটনৈতিক ক্যাডারের আমলারা। নাকি লবিস্ট নিয়োগ করেও তাঁদের ভাবমূর্তি উন্নয়নে যে সাফল্য মিলছে না, সেই তথ্য তাঁরা আড়াল করতে চেয়েছেন? 


শাহরিয়ার আলম গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন যে সরকার কোনো লবিস্ট নিয়োগ করেনি, পিআর (জনসংযোগ) ফার্ম নিয়োগ করেছে। বিজিআর কোনো সাধারণ মানের লবিস্ট প্রতিষ্ঠান নয়, ২০২০ সালে তারা বর্ষসেরা লবিস্ট (লবিস্ট অব দ্য ইয়ার) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, যে ঘোষণাটি তাদের ওয়েবসাইটেই জ্বলজ্বল করছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের হয়েও প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের একটি বড় অংশই হচ্ছে পিআর, বা জনসংযোগ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, আইনপ্রণেতা, নীতিনির্ধারক এবং গণমাধ্যমে নিয়োগকারীর ভাষ্য ও স্বার্থ প্রচার ও সংরক্ষণই লবিস্টের কাজ বিধায় জনসংযোগকে লবিং থেকে আলাদা করে দেখানোর কোনো অবকাশ নেই।     

  

এতো গেল সরকারের কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের রেকর্ডটি কী প্রতিমন্ত্রী আমাদের জানাবেন? গত নির্বাচনের প্রাক্কালে মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিদেশে লবিংয়ের অভিযোগ করতে থাকলে অনুসন্ধান করা দেখা যায়, লবিংয়ে কেউই কম যান না। প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ অ্যালক্যাড অ্যান্ড ফে নামের লবিং প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ লাখ ডলারের (১০ কোটি টাকার বেশি) বেশি দিয়েছে। প্রথম চুক্তিটি করা হয় ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর, যা কার্যকর হয় ১ জানুয়ারি ২০০৫ থাকে। প্রকাশিত চুক্তির শর্তে দেখা যায়, তাদের মাসিক ফি ছিল ৩০ হাজার ডলার (২৪ লাখ টাকা) করে। ফি-এর বাইরে অন্যান্য খরচ, যেমন গণমাধ্যম বা গবেষকদের সফরের খরচ আলাদাভাবে পরিশোধের কথাও চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু তার হিসাব প্রকাশ করা হয়নি।  আওয়ামী লীগের আগে যুক্তরাষ্ট্রে  বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দলের পেশাদার লবিং প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণের কথা জানা যায় না। এসব তথ্য দেশটির ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের (ফারা) আওতায় জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের অনলাইনে প্রকাশিত নথিতেই রয়েছে। 


লবিং নিয়ে বিতর্কের মূলে আছে দেশের মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের দৈন্যদশা। র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাতেই আছে যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন থেকেই তারা মানবাধকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ পেয়ে আসছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এমনেস্টি, কিম্বা জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনগুলো বন্ধ বা আড়াল করার কোনো অবকাশ নেই। অতীতে আওয়ামী লীগও এসব সংগঠনের প্রতিবেদন বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে উদ্ধৃত করেছে। তাই, মূল সমস্যায় নজর দিয়ে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থাতেই বরং সরকারের মনোযোগী হওয়া কাম্য। 


(১৯ জানুয়ারি, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...