সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বর্জনপীড়িত নির্বাচন কমিশন বাছাই কমিটি

নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির নিষ্ফল সংলাপের পর সংক্ষিপ্ততম সময়ে আইন তৈরির মাধ্যমে গঠিত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বধীন একটি অনুসন্ধান কমিটি আরও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যোগ্য ব্যাক্তি বাছাই করছে। ক্ষিপ্রতার কথা বলছি, কেননা রাজনীতিকদের মধ্য থেকেই কথা উঠেছে , `২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্তসহ নাম দেওয়া সম্ভব নয়`(খেলাফতের ভারপ্রাপ্ত আবদুল আজিজ, সমকাল)। তারপরও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনের মনোনয়ন ও ব্যাক্তিগত আবেদন মিলিয়ে মোট ৩২৯ জনের নাম প্রস্তাব পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। 


অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১৩৬ জন এবং পেশাজীবীদের কাছ থেকে ৪০ জন। বাকিরা স্বমনোনীত। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলগুলো সবাই ১০টি করে নাম দিলে তার সংখ্যাই হতো ৩৯০। সেদিক দিয়ে কমিটির কাজ অনেকটাই কমেছে। দৈনিক সমকাল জানিয়েছে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে বিএনপি, তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক এবং ডান ও বাম ধারার ১৮টি দল ( প্রথম আলোর হিসাবে ১৫) সার্চ কমিটিতে নামের তালিকা দেয়নি, যাকে কমিটি বর্জন বলে বর্ণনা করা যায়। 


যেসব দল নাম প্রস্তাব করেনি, তাদের মধ্যে ১৩টি দলের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী যাদের চাইবেন, তাঁদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, তাই নাম দেওয়া অর্থহীন। বাকি পাঁচটি দল বিলম্বে চিঠি পাওয়া এবং প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার কথা উল্লেখ করে সময় স্বল্পতার কারণে নাম প্রস্তাব করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে। নাম গ্রহণের পালা যেহেতু শেষ হয়েছে, সেহেতু এখন স্পষ্ট হয়েছে যে ক্ষমতাসীন সরকারের জোট শরিক ও সুবিধাভোগী (যেমন আসন সমঝোতায় নির্বাচন করা সংসদীয় বিরোধীদল জাতীয় পার্টি) ছাড়া অন্যান্য দল অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। শুধু বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরাই নয়, সিপিবি, জেএসডি, বাসদ, বামজোটের শরীক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মত দল যেমন নাম দেয়নি, তেমনি ধর্মভিত্তিক দল খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্টের মত দলগুলোও এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে থেকেছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপি জোটের সাবেক শরিক আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপিও কোনো প্রস্তাব দেয়নি। আগের দুটি বাছাই প্রক্রিয়ায় বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো নাম প্রস্তাব করে অংশ নিয়েছিল। সুতরাং, মানতেই হবে আগের দুটি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া আইনসম্মত না হলেও তাতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের অংশগ্রহণ একধরণের গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছিল, যা চলমান আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত।    


অনুসন্ধান কমিটি অবশ্য অন্য একটি দিক থেকে কিছুটা সৌভাগ্যবান। কেননা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কোনোধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিয়েছেন। অতীতে তাঁরা এতোটা কদর পেয়েছেন বলে মনে পড়ে না। তখন টিভির পর্দায় টকশো, নয়তো পত্রিকায় লিখে তাঁদের মতামত জানাতে হয়েছে। এবারে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যেও যাঁরা সরকারে ঘনিষ্ঠ, অথবা বিভিন্নভাবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও বলেছেন, `যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তারা যেন, সৎ, নিষ্ঠাবান এবং যোগ্য হন। আর্থিক মোহ বা যেকোনো মোহের বাইরে থেকে যেন নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেন।` বিদায়ী কমিশনের প্রধান ও তাঁর সহযোগীরা বিদায়ের প্রাক্কালে এসব মন্তব্য থেকে অবশ্য লজ্জা পাবেন বলে মনে হয় না, কেননা সেই বোধ তাঁরা অনেক আগেই হারিয়েছেন।  


নাগরিক সমাজের যেসব প্রতিনিধি কমিটির আমন্ত্রণে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই জোর দিয়েছেন যে বিষয়টির ওপর, তা হচ্ছে বিশেষ সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পান। সুষ্ঠু নির্বাচন করার মত সাহস থাকবে এমন নিরপেক্ষ, সৎ, নিষ্ঠাবান এবং যোগ্য ব্যাক্তিদের নাম সুপারিশ করার ওপর তাঁরা জোর দিয়েছেন। তাঁদের আরেকটি পরামর্শ হচ্ছে, স্বচ্ছ্বতার স্বার্থে সবার নামের তালিকা প্রকাশ করা। ১৩ বছর একটি দল ক্ষমতায় থাকার সময়ে প্রশাসন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যে ব্যপক দলীয়করণ হয়েছে, তাতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সুপারিশ অনুসরণের কাজটা মোটেও সহজ নয়। তবে, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে কমিটি আদৌ ততটা সাহসী হবে কিনা? কমিটির সদস্যদের অনেকেরই অতীতের রাজনৈতিক অবস্থানের কথাও তো অজানা কিছু নয়।  


রাজনৈতিক দলগুলো যাঁদের নাম প্রস্তাব করেছে, ধরে নেওয়া যায় তাঁদের সম্মতি নিয়েই তা করা হয়েছে। এ সম্মতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জনপরিসরে তাঁদের ব্যাক্তিজীবন এখন যৌক্তিক কারণেই নিবিড় পর্যালোচনার বিষয়বস্তু হবে। তালিকায় নাম প্রস্তাবের পর শেষতক কমিশনে মনোনীত না হলে সমাজে যে তার কোনো বিরুপ প্রভাব পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী? সে কারণেই সম্মতির প্রশ্নটি কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। স্বমনোনীতদের কথা অবশ্য আলাদা। 


ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটিতে উচ্চ আদালতের দুজন বিচারপতিসহ তিনজন বিচারকাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাঁদের নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে বিচারপ্রার্থী অথবা বিবাদী, কোনোপক্ষ যদি আদালতের এখতিয়ার কিম্বা তার প্রতি আস্থার বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে সেই প্রশ্নটি নিষ্পত্তি করাই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। কেননা, শুধু ন্যয়বিচার করলেই হয় না, ন্যয়বিচার যে হয়েছে সেটি দেখানোও প্রয়োজন হয়। বর্তমান বাছাই কমিটির প্রতি দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় অর্ধেকই যেখানে তাঁদের প্রতি আস্থা প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সেহেতু এই বাধাটি কীভাবে অতিক্রম করা যায়, প্রথমে সেটিই তাঁদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। অন্যথায়, `নির্বাচন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়াই লোক দেখানো`জেএসডি নেতা শহীদ উদ্দিন মাহমুদের অভিযোগ নাকচ করা সহজ হবে না।  


নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন নিয়ে তড়িঘড়ির যেসব সমালোচনা উঠেছে, সরকার সেগুলো নাকচ করে দিলেও এখন ক্রমশই তার দূর্বলতার দিকগুলো খোলাসা হতে থাকবে। এরকম একটি বিষয় হলো বিচারপতিদের অনাকাংখিত রাজনৈতিক বিতর্কের মুখোমুখি হওয়া। অথচ সংবিধানের ৯৪ ধারায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যেসব দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা আছে, তাতে বিচার বিভাগের বাইরে কোনো কাজে তাঁদের যুক্ত হওয়ার কথা নয়। কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেওয়া সরকার এখন রাজনৈতিক স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে তাঁদের সম্পৃক্ত করে ঠিক সেই ঝুঁকির মুখেই ঠেলে দিয়েছে।    


রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অংশগ্রহণ ছাড়া নিজেদের কাজকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা এই কমিটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই কমিটির সুপারিশ  অনুযায়ী  আগামী কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণও তার চেয়ে কম দুরুহ নয়। বাছাইপ্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অনাস্থা ও অংশগ্রহণে অস্বীকৃতির কারণে শুরু থেকেই বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে কারা রাজি হবেন? সত্যিকারভাবে নিরপেক্ষ, যোগ্য ও অবিতর্কিত কেউ কেন নিজের সুনাম ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে চাইবেন? সম্ভবত সেকারণেই দলীয় আগ্রহ বা আনুগত্যে অনুপ্রাণিত প্রার্থীর সংখ্যা কিছুটা বেশি। এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো শিগগিরই পাওয়া যাবে, তবে কমিটির সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা শিগগির দূর হবে না। 


(১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...