মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাদে বিশ্বাসীদের কাছে সমাজতন্ত্রের পথপ্রদর্শক রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের যে বিশেষ মর্যাদা ও ভালোবাসা ছিল, তাতে অনেকেই এখনও মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছেন। লেনিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তার কোনো অংশই যে আর লেনিন নির্দেশিত পথে নেই, চীনও যে এখন নতুন ধরণের পুঁজিবাদী পথে সমৃদ্ধি খুঁজে নিচ্ছে, সে কথা অনেকের কাছে শুধুই পাশ্চাত্যের অপপ্রচার। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে তাই রাশিয়া কিম্বা চীনের যে কোনো চ্যালেঞ্জ এদের অনেককেই কিছুটা উজ্জীবিত করে তোলে। ইউক্রেন সংকটও কোনো ব্যতিক্রম নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লিবিয়ায় অন্যায় সামরিক অভিযান-হস্তক্ষেপ ও তার পরিণতিতে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়গুলোর কারণে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রায় শূণ্যের ঘরে। এ রকম পটভূমিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনমুখী তৎপরতার বিষয়ে কিছুটা নিস্পৃহতার নীতি বেশ যৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই সংকটের সম্ভাব্য প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আমাদের কারও জন্যই উপেক্ষণীয় নয়।
সম্ভাব্য প্রাণহানি ও মানবিক দূর্যোগের আশঙ্কার বাইরেও ইউক্রেন সংকটের প্রত্যক্ষ ও আশু প্রভাব ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বের সবাই টের পেতে আরম্ভ করেছে। বাংলাদেশিদের বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার ধারায় ইউক্রেনে যে হাজারখানেকের বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন, তাঁদের পরিবার ও স্বজনদের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। আর এ মানবিক দূর্ভাবনার বাইরে ইউক্রেন সংকটের যেসব প্রভাব বিশ্ব জুড়েই অনুভূত হতে শুরু করেছে, তার প্রধান কারণ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া। রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় প্রধান জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ হওয়ায় বাজারে অস্থিরতা আরও বাড়বে বলেই সবার আশংকা। জার্মানির গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৬৫ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে এবং ওই গ্যাস সঞ্চালনের দ্বিতীয় পাইপলাইন নর্ডস্ট্রিম -২-এর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরও ইউক্রেন সংকটের কারণে জার্মান সরকার তা চালু করার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া বলেছে ইউরোপের ভোক্তাদের জ্বালানি খরচ এখন দ্বিগুণ হবে। জ্বালানির দাম যে শুধু ইউরোপীয়দের জন্য দ্বিগুণ হবে, তা তো নয়; আমাদের সবার জন্যই হবে। গ্যাস-বিদ্যূতের দাম বাড়ায় যাঁরা হাঁসফাঁস করছেন, তাঁদের জন্য তা আরও অসহনীয় হতে বাধ্য। আর জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ায় পিছিয়ে থাকবে না।
জ্বালানি ছাড়াও খাদ্যশস্যের বাজারেও এ সংকটের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কেননা, গম, ভুট্টা ও যবের মত দানাদার শস্য উৎপাদনে ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনের রপ্তানি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়ার প্রভাবে ভারতীয় সরবরাহকারী বাংলাদেশে রপ্তানির দাম বাড়িয়েছে বলে ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। সুতরাং, চালের বাজার উর্ধ্বমুখী বলে যদি কেউ রুটি খাওয়ার কথা ভাবতে চান, তাঁর জন্য ইউক্রেন আরেকটি দুঃসংবাদ।
এসব অর্থনৈতিক ঝুঁকি ছাড়াও ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক বিপদ কোনো অংশেই কম নয়। ইউক্রেনের দনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে তাঁর ভাষায় গণহত্যা বন্ধে শান্তিরক্ষী হিসাবে রুশ সেনাবহর পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি। উপরন্তু তিনি ইউক্রেন রাষ্ট্রকে কল্পকাহিনি বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৯১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ৩৩ বছর পর ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে তাকে রাশিয়ার কাছে নতজানু হতে বাধ্য করার তোড়জোড় চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। জাতিসংঘ মহাসচিব ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার অবস্থানকে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন।
ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর রাশিয়ার এ হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর জন্য এক ভয়াবহ নজির তৈরি করছে। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাই যে স্বাধীনতার গ্যারান্টি নয়, ইউক্রেনের অসহায়ত্বে তার প্রমাণ মিলছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো অন্য সবার জন্যই অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। শুধু প্রাচীন কিম্বা মধ্যযুগের ইতিহাস নয়, এমনকি ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান উদ্ধৃত করে কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আকাঙ্খার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী শতরু-মিত্র হয় না। প্রতিবেশীর সঙ্গেও সম্পর্ক যে সবসময় এক থাকে না, ইউক্রেন তা ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলো উদ্বিগ্ন যে ইউক্রনের পর কী তারাই রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য?
বাংলাদেশের সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতের বন্ধুত্ব ও সৌহর্দ্য এখন খুবই উষ্ণ এবং এ রকম সুসমম্পর্ক বজায় থাকবে, সেটাই সাধারণ প্রত্যাশা। কিন্তু, অনাকাঙ্খিত আশঙ্কাকে কি নাকচ করে দেওয়া যায়? ভারতে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী্র রাজনৈতিক উত্থানের কথা এক্ষেত্রে বিস্মৃত হওয়া চলে না। রাজনীতিতে প্রান্তিক নয়, মূলধারার অনেকের কিছু মন্তব্য এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আর এস এস এর প্রধান মোহন ভগবত গতবছরের ২৬ নভেম্বর একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অখন্ড ভারত পুনরুজ্জীবনের কথা বলেছেন। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রামমাধব ২০১৫ সালে আল-জাজিরার মেহেদি হাসানের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এক হয়ে আবারও অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা হবে। বিজেপির রাজ্যসভা সদস্য সুব্রাক্ষ্মানিয়াম স্বামী এক্ষেত্রে আরও কট্টর নীতির প্রবক্তা। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর তিনি আগরতলায় হিন্দুদের নিপীড়ণ থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন (ঢাকা ট্রিবিউন)।
ইউক্রেনের সংকট শুধু শান্তিবাদী ও যুদ্ধবিরোধীদের জন্য নয়, গণতন্ত্রপন্থীদের জন্যও দুঃসংবাদ। কেননা, এ ধরণের বৈশ্বিক সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ নিবিষ্ট থাকার মানে হচ্ছে, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ওপর থেকে নজর সরে যাওয়া। এমনকি এধরণের সংকটে পক্ষে-বিপক্ষে জোট তৈরি ও তা সংহত করার স্বার্থে কখনো কখনো অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের নানাধরণের ছাড় দেওয়া হয়। নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার হামলার পর দেখা গেল পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে বিশ্বনেতারা নিঃসংকোচে লেনদেন করছেন। শুধু জেনারেল মোশাররফ নন,বিশের তাবৎ স্বৈরশাসকদের সহায়তা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো। বস্তুতঃ গত শতাব্দীর শেষ দিকে বিশ্বে যে গণতন্ত্রায়নের ঢেউ উঠেছিল, তা মিইয়ে যায় আল-কায়েদা ও ইসলামপন্থী জঙ্গীবাদ দমনের সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে।
গণতন্ত্রের সেই পিছু হটা এখনো চলছে। বস্তুত বিশ্বের নানা প্রান্তে নাগরিক অধিকারের গুরুতর সংকোচন ঘটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাজনীতিকরা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন, ভিন্নমত ও সমালোচনার পরিসর ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে, জবাবদিহিহীনতা ও দায়মুক্তির কারণে ন্যয়বিচার ও আইনের শাসন নির্বাসিত হচ্ছে।
এ কথাও সত্য যে এসব হতাশাজনক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও নাগরিক সমাজের মধ্য থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারের সমর্থনে বৈশ্বিক সংহতি জোরদার হওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছিল। ইউক্রেন সংকটের কারণে সেই সমর্থনে ভাটা পড়ার আশঙ্কাই বেশি। সে কারণে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রুপ নিলে তাতে পক্ষে-বিপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পদ ও প্রাণশক্তি দুটোরই ক্ষয়সাধন হবে, যা গণতন্ত্রকামীদের জন্যও বড় দুঃসংবাদ।
(২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন