সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নির্বাচন কমিশনের নাম প্রস্তাব নিয়ে লুকোচুরি কেন

নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য রাজনৈতিক দল ও কয়েকটি পেশাজীবি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা নামগুলো নিয়ে যে লুকোচুরি চলছে, তাকে শুধু বিস্ময়কর নয়, বরং কিছুটা উদ্দেশ্যমূলকই বলতে হবে। নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর দাবির মুখে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি প্রস্তাবিত নামগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে, যদিও সাচিবিক সহায়তা দেওয়ায় অসতর্কতায় সাতজনের নাম দুবার করে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এধরণের ভুল অন্তত আর যার কাছে হোক, রাষ্ট্রের সবচেয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে প্রত্যাশিত নয়। তারপরও তালিকার এক-তৃতীয়াংশ নামে আমাদের করিৎকর্মা আমলাদের প্রতি রাজনীতিকদের অগাধ আস্থার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে। তবে রাজনীতিকরা আমাদের কাছ থেকে যা আড়াল করতে চান, তা হলো কাকে, কোন বিবেচনায় তাঁরা বেছে নিয়ে একটি সাংবিধানিক পদে আসীন করতে চাইছেন।


৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ১৮টি দল কোনো নাম দেয়নি, তাদের অধিকাংশের অভিযোগ, এই প্রক্রিয়াট সাজানো এবং তাদের মূল আপত্তি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। কিন্তু, যেসব দল তাদের পছন্দের নাম প্রস্তাব করেছে, তারা তা প্রকাশ করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ, বাছাইপ্রক্রিয়ার এ অংশটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেন এ অংশ গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্য দুটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী শরিক, সংসদীয় বিরোধীদল জাতীয় পার্টি যে তালিকা দিয়েছে, তাতে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হকের স্ত্রী সাবেক সচিব রোকসানা কাদেরের নাম রয়েছে এক নম্বরে। তাঁর স্ত্রীর নাম এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপের সময়েও তাঁর দল থেকে দেওয়া হয়েছিল।সমকাল পত্রিকা দলটির দায়িত্বশীল সূত্রকে উদ্ধৃত করে এই তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি আরও জানিয়েছে, দলটির প্রস্তাবকৃত ১০ জনের মধ্যে তাঁর ২ জন সহকর্মী সাবেক বিচারক রয়েছেন। তালিকায় অনেকেই আছেন, যাঁরা গত নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। একজন সুপরিচিত সাংবাদিক নেতাও আছেন, যিনি ক্ষমতাসীন দলের হয়ে নির্বাচন করে একবার পরাজিত হয়েছেন। 


বাছাই কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছেন যিনি, তাঁর স্ত্রী সাবেক সচিব কামরুন নাহারের নামও রয়েছে তালিকায়। কামরুন নাহারের নাম প্রস্তাবের আগে তাঁর সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু তাঁর নাম যদি কোন রাজনৈতিক দল থেকে করা হয়ে থাকে, তাহলে সেই দলের নেতাদের যুক্তিটিও স্পষ্ট হওয়া দরকার। বাছাইপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কারও পরিবারের কোনো সদস্যের নাম প্রস্তাব যে সংগত নয়, সেটা তাঁদের অজানা থাকার কথা নয়। সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত কিম্বা স্বজনপ্রীতির প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কোনো কিছুই এধরণের সাংবিধানিক পদের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কাম্য নয়।  

 

কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা কেন প্রকাশ করতে চায় না, তার একটি ব্যখ্যা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক। তিনি বলেছেন, `নাম প্রকাশ হলে বিতর্ক হতে পারে`। তিনি একইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলও তাদের প্রস্তাব করা নামগুলো প্রকাশ করেনি। আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তাবিত নামগুলো প্রকাশ না কারার কারণ না জানালেও নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়, এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান। বিতর্ক এড়ানোর তাগিদ থেকে নাম প্রকাশ না করার যে যুক্তি জাতীয় পার্টি নেতা দিয়েছেন, তার লক্ষ্য স্পষ্ট। নিয়োগের আগে বিতর্ক হলে জনবিরোধিতার মুখে তাঁদের প্রত্যশা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ফলে নির্বাচনের সময়ে আত্মীয়তার সুবিধা নেওয়ার সম্ভাবনা ভন্ডুল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলের পেশ করা তালিকা প্রকাশ সম্পর্কে ওয়ার্কার্স পার্টির অবস্থানও অভিন্ন বলেই মনে হয়। কেননা, দলটির নেতা রাশেদ খান মেনন শুধু বাছাই কমিটি রাষ্ট্রপতির যে ১০ জনের নাম পাঠাবে, সেই তালিকাটি প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। নিজেরা কাদের নাম প্রস্তাব করেছেন, তা খোলাসা করেন নি। 


২০১৭ সালে যে কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশনের বাছাই কমিটিও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নামের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তা প্রকাশ করেনি। কিন্তু পরে জানা গেল প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক তরীকত ফেডারেশনের প্রস্তাব অভাবনীয় গুরুত্ব পেয়েছে। আরও পরে জানা গেল যে ক্ষমতাসীন জোটের শরীকদের দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করানোর বিষয়টি ছিল আওয়ামী লীগেরই কৌশল। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যে নামগুলো বেশি এসেছে, তারাই শেষপর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন। এবারেও একই কৌশল নেওয়া হয়েছে কিনা, দলগুলোর তালিকা না পেলে তা বোঝা যাবে না।  


এবার নাম প্রস্তাব করার সুযোগ আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। কয়েকটি পেশাজীবি সংগঠন এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্যেও সুযোগটি উন্মুক্ত ছিল। তবে পেশাজীবি সংগঠনগুলো্র নেতৃত্ব কার্যত যে ক্ষমতাসীন দলেরই সমর্থক, সে কথা সবারই জানা। অন্যদিকে, বাম-ডান-মধ্যপন্থী মিলিয়ে বিরোধীদলগুলোর এই বাছাই প্রক্রিয়ায় অনাস্থা প্রকাশ ও বর্জনের কারণে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও যে তেমন একটা উৎসাহ তৈরি হয়েছিল, সে কথা বলা যাবে না। সে রকম হলে ব্যাক্তিগত আবেদনের সংখ্যা হাজার না ছুঁলেও কয়েক শ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। ফলে স্বমনোনয়নে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বা তদবিরবাজদেরই বেশি আগ্রহী হওয়ার কথা। 


নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের কয়েকজন ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে তাঁরা ওই দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী নন এবং তাঁরা তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন। বাছাইপ্রক্রিয়া ও কমিটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরোধীদলগুলোর আপত্তির কারণেও এঁদের কেউ কেঊ নিজেদের বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে না-ও চাইতে পারেন।দু-একজন এমন কথাও বলেছেন যে তাঁদের সম্মতি না নিয়ে বা অজ্ঞাতে তাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অন্যায়। একান্তই দলীয় লোক না হলে কোনো দলই কোনো ব্যক্তির উপর তার দলীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। এ কারণেও দলগুলোর মনোনয়নে স্বচ্ছ্বতা কাম্য। 


নাগরিক সমাজের যে সব প্রতিনিধি কমিটির আমন্ত্রণে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন, তাঁদের প্রধান চাওয়া হচ্ছে বিশেষ সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পায়। রাজনীতিকদের ভয় কি এখানেই? তা না হলে প্রস্তাবকারী অজ্ঞাত থাকবে কেন? বিষয়টি কি রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপন রাখার মতো? তারা আইন মেনে নির্বাচন কমিশনে দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন, কিন্তু তা জনসমক্ষে প্রকাশে তাদের ঘোর আপত্তি। ফলে ভোটারদের জানার উপায় নেই ব্যবসায়ীরা যে এত বেশি সংখ্যায় মনোনয়ন পান, তার রহস্যটা কী? দলকে মোটা অংকের চাঁদা দেওয়া, নাকি অন্য কোনো লেনদেন?  


নাগরিকদের সঙ্গে এই লুকোচুরির অবসান হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের অনেক দূর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছ্বতার সঙ্গে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা আছে। তার আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে কমিটি নিজেদের দায় অনেকটাই লাঘব করতে পারে। তাহলে অন্তত নিজের স্ত্রী , আত্মীয় বা দলীয় মনোনয়ন চাওয়া ব্যাক্তিদের নির্বাচন কমিশনে জায়গা করে নেওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কমলেও কমতে পারে। 


(১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...