সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদালতে কাঠগড়ার বদলে খাঁচা কেন?

 আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় হঠাৎ নীরবে এক বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমনকি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেও যার চল ছিল না, তা–ই এখন চালু হয়েছে। তবে, কীভাবে তা সম্ভব হলো, তা অস্পষ্ট ও রহস্যময়। ঢাকার কয়েকটি আদালতের যে ছবি ও বিবরণ পাওয়া গেছে, তাতে তা কায়রো বা মস্কোর আদালত কি না, সেই বিভ্রমেরও আশঙ্কা আছে। আদালতের কাঠগড়ার জায়গায় এসেছে লোহার খাঁচা। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। চিড়িয়াখানার পোষা প্রাণীদের যে ধরনের খাঁচায় রাখা হয়, সে রকম খাঁচা। 


হয়তো কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠছে, কাঠগড়ার বদলে খাঁচার ব্যবস্থায় সমস্যা কী? সমস্যা দুটি – প্রথমত, আইনের চোখে ন্যায্যতা ও সমতার নীতি অনুযায়ী আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগপর্যন্ত যেহেতু আসামীকে নির্দোষ গণ্য করতে হয়, সেহেতু তার প্রতি এমন কোনো আচরণ করা যায় না, যা নিবর্তনমূলক ও বিচারের আগেই তাঁর প্রতি দোষীর ন্যয় আচরণ বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়ত, খাঁচায় আটকে রাখা অমানবিক, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণকারী ও নিষ্ঠুর আচরণ। 


আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫–এর (৫)–এ বলা হচ্ছে, ”কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্চনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরুপ ব্যবহার করা যাইবে না।” এটি আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সনদ, ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসেরও (আইসিসিপিআর) পরিপন্থী। বাংলাদেশ ওই সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদের ৭ নম্বর ধারা আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৫)–এর অনুরূপ। 


এ ছাড়া সনদের অনুচ্ছেদ ১৪ (২)–এ বলা হচ্ছে, ’ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেকে আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত নিরাপরাধ গণ্য হওয়ার অধিকারী।’ এই পরিবর্তনের জন্য নতুন কোনো আইন তৈরি বা বিদ্যমান ফৌজদারি আইনের কোনো সংশোধনীর কথাও জানা যায় না। তাহলে কোন আইনে এটি করা হয়েছে?


বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, দুধর্ষ জঙ্গিদের বিচারের সময়েও কিন্তু এধরনের খাঁচার প্রয়োজন হয় নি। দেশের অপরাধীরা যে আগের তুলনায় বেশি বেয়াড়া বা হিংস্র হয়ে উঠছে, এমনও নয়। আদালত অঙ্গন থেকে জঙ্গি আসামী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বটে, তবে তার পুরো দায় আসামীদের হেফাজত ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। 


কয়েক দশক আগেও পূর্ব ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে আদালতে এ ধরনের খাঁচার প্রচলন ছিল। আশির দশকের বহুল আলোচিত পেরুর মাওবাদী গেরিলা নেতা শাইনিং পাথের প্রতিষ্ঠাতা আবিমেল গুজমানের খাাঁচায় বন্দী ছবির কথা এখনো অনেকে ভুলতে পারেন না। তবে ওই সব দেশের অধিকাংশই পরে তা বর্জন করেছে। এখন সম্ভবত মিশরই একমাত্র দেশ, যেখানে নিয়মিত আদালতে লোহার খাঁচায় আসামীদের দাঁড়াতে হয়। রাশিয়া ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে জরিমানা দেওয়ার পর কিছুটা পরিবর্তন এনে বিপজ্জনক গণ্য করা আসামীদের জন্য কাঁচের আলাদা প্রকোষ্ঠ (চেম্বার) তৈরি করেছে। তবে মানবাধিকার সংগঠকদের অনেকেই সেটি সমর্থন করেন না। 


উন্নত গণতন্ত্রে এখন শুরু হয়েছে কাঠগড়াও তুলে দেওয়ার পালা। যুক্তরাষ্ট্রে কাঠগড়া তুলে দেওয়া হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলেছে। সেখানে আসামি তাঁর কৌঁসুলীর পাশে বসেন এবং অপরাধ গুরুতর হলে বা আসামির আচরণ বিপজ্জনক হলে তাঁকে নিবৃত্ত রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পায়ের বেড়ি কিম্বা শেকল এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যেন তা দেখা না যায়। অথচ পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিপজ্জনক আসামী বন্দী আছে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোতে। 


যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের এ রীতির ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিচারের জন্য নিয়োজিত ১১ জন জুরর, যাঁরা সাধারণ নাগরিক কিন্তু আদালত কর্তৃক অপরাধ বিচারের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের ওপর যাতে কোনো রকম মানসিক প্রভাব না পড়ে। অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে কাঠগড়ায় দেখলে অপরাধী মনে করার মানসিক চাপ থেকে জুররদের মুক্ত রাখাই এর উদ্দেশ্য। কেননা আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেই নিরপরাধ এবং অন্যদের মতোই সমমর্যাদা ও সম–অধিকারের দাবিদার। 


ব্রিটেনেও কাঠগড়া তুলে দেওয়ার আলোচনা জোরদার হচ্ছে। সর্বদলীয় আইন সংস্কার ও মানবাধিকার বিষয়ক একটি গোষ্ঠী, জাস্টিস ২০১৫ সালে এক গবেষণা প্রতিবদন প্রকাশ করে, যার নাম হচ্ছে কাঠগড়ায়, ফৌজদারি অপরাধের বিচারে কাঠগড়ার ব্যবহার পুন:পর্যালোচনা ( ইন দ্য ডকস, রিঅ্যাসেসিং দ্য ইউজ অব দ্য ডক ইন ক্রিমিনাল ট্রায়ালস) । তারা বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে যে সুপারিশমালা প্রকাশ করেছে, যাতে সব অভিযুক্তকে তাঁদের আইনজীবিদের পিছনে বা কাছাকাছি বসতে দেওয়া, কাঠগড়া অপসারণ, নিরাপত্তা উদ্বেগ থাকলে তা নিয়ে আদালতে পদ্ধতিগত বিষয়ে শুনানি করে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা যেন জুরি সদস্যদের কাছে দৃশ্যমান না হয়, এমন ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি। 


আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি শুধু আসামীদের কাছ থেকেই আসে, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। আগেই উল্লেখ করেছি, দেশে আসামি ছিনতাইয়ের সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাটি ঘটেছিল কারাগার থেকে আদালতে আসামিকে আনা–নেওয়ার পথে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্য যে দুটি ঘটনাকে দুধর্ষ আসামী ছিনতাই হিসেবে গণ্য করা হয়, তা–ও ঘটেছে মূল আদালত ভবনের বাইরে। আদালত প্রাঙ্গন থেকে আসামি পালানোর যেসব ঘটনার কথা জানা যায়, সেগুলোও আদালত সংলগ্ন পুলিশের হেফাজতখানা থেকে।  


দুধর্ষ ও বিপজ্জনক বলে যেসব আসামির আচরণ বা অতীত রেকর্ড আছে, তাঁদের বিচারে এখন বিশ্বের অনেক দেশেই তাঁদের কারাগারে রেখেই ভিডিও মাধ্যমে বিচারকাজে যুক্ত করা হয়। মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ  বিকল্পের দিকে যখন সবাই এগোচ্ছে, তখন কেন আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি? 


নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো, এরকম অমানবিক, মানুষের মর্যাদা হানিকর এ খাঁচায় দাঁড়িয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মানবাধিকারের জন্য লড়াই করে আর্ন্তজাতিক পুরস্কার পাওয়া মানবাধিকারকর্মীকেও। আর্ন্তজাতিক পরিসরে পরিচিতি পাওয়া অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও একই সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান বন্দী নন, জামিনে আছেন। কিন্তু আদালতে তাঁদের খাঁচায় আটকে বিচার করার বিষয়ে ইতিমধ্যেই বিদেশি মানবাধিকার সংগঠকদের অনেকেই টুইটারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কাছে তাঁরা যে বহুলভাবে নিন্দিত, তা সবারই জানা। কিন্তু তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়ায় মানবমর্যাদা ক্ষুণ্ণকারী অমানবিক আচরণ কার্যত সরকারের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। 


গোড়ার দিকে মিশরের কথা বলেছিলাম, দেশটিতে সব ফৌজদারি মামলাতেই বিচারের সময়ে আদালতে অভিযুক্তদের খাঁচায় আটকে রাখা হয়। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, দেশটিতে ১৯৮১ থেকে ২০১১  সাল পর্যন্ত লৌহমানবের মতো শাসন পরিচালনাকারী হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর বিচারের মুখোমুখি হলে তাঁকেও একইরকম খাঁচায় পুরে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। 


( ৩ জুলাই, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)




 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...