ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অতিসম্প্রতি খুবই গুরুতর কিছু কথা বলেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় গত শনিবার মিরপুর-১ নম্বরের দারুস সালাম বালুর মাঠে তাঁর দলীয় এক আলোচনা সভার বক্তব্য। ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেওয়া হবে না – বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন, ’তারা বলে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের লোকজনের কোনো ক্ষতি হবে না। কী সুন্দর কথা ! আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তারা আবার ক্ষমতায় আসলে এক রাতের মধ্যে বাকিটা শেষ করে দেবে। এটা তাদের ভেতরের কথা।’
তাঁর এই বক্তব্যের ভিত্তি ও উদ্দেশ্য কী, তা মোটেও পরিষ্কার নয়। তাঁর কথায় যে ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা ও সহিংসতার আশঙ্কার কথা আছে, তা কি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক কথা? নাকি অনুমান? চলতি দফা আন্দোলনে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো সহিংসতার নীতি অনুসরণ করেছে বলে দেখা যায়না; বরং উল্টোটাই ঘটছে। আগে সভা–সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ মারধর করে তাদের হটিয়ে দিত, আর এখন বিএনপিকে মাঠে থাকতে না দেওয়ার কাজটা দলীয় লোকজনই করছে। তাতে অস্ত্রের ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে।
ওবায়দুল কাদেরের কথা যদি অনুমাননির্ভর হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তাঁর এমন অভিযোগের উদ্দেশ্য কী? আতঙ্ক তৈরি করে নিজেদের কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া নিশ্চয়ই তাঁর উদ্দেশ্য নয়? তাহলে কি বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দলীয় লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যই এসব কথা? বিএনপিকে আত্মরক্ষার জন্য সহিংস পথে যেতে বাধ্য করার লক্ষ্য থেকে নিজেদের কর্মী–সমর্থকদের আরো উত্তেজিত করাই কী উদ্দেশ্য?
বিএনপি কবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল? ইতিহাস তো বলে আওয়ামী লীগ যখনই বিরোধীদলে থেকেছে, তখনই বিএনপিকে তারা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। খালোদা জিয়ার প্রথম মেয়াদের সময় আওয়ামী লীগ হরতাল করেছিল সম্ভবত ১৭৩ দিন। দ্বিতীয় মেয়াদেও হিসাব করলে দেখা যাবে বছরে গড়ে অন্তত ডজনখানেক হরতাল হয়েছে। সেগুলোর কোনোটাই সাদামাটা ছিল না, টানটান উত্তেজনায় ভরা ছিল। তখন মিছিল–সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি্রও চল ছিল না। সহিংসতারও কমতি ছিল না। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে যখনই বাড়াবাড়ি করেছে, তখনই তার প্রতিবাদ হয়েছে, তখন তারা মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারেনি। সেই তুলনায় ২০১৪ সালের পর থেকে গত মে মাসের আগপর্যন্ত বিএনপি সভা করার সুযোগ কয়বার পেয়েছে, তার হিসাব সম্ভবত হাতের আঙ্গুল গুনেই বলা যাবে।
তবে একথা সত্যি যে বিএনপি হঠাৎ করেই যেন জেগে উঠেছে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারীদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়ার পর এখন নিয়মিতই তারা ঢাকা ও দেশের নানা প্রান্তে বড় বড় সমাবেশ করছে। আওয়ামী লীগ অবশ্য এতে বিদেশিদের যোগসূত্র দেখছে এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। বিদেশিরা যতই বলুক যে তারা কোনো দলের পক্ষে নয়, গণতন্ত্রের পক্ষে এবং সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়; আওয়ামী লীগের ততই অভিযোগ যে সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দিলে ক্ষমতায় থাকা যায় = এমন কথাও বলা হয়েছে। যার মানে দাঁড়ায়, দেশের ভোটারদের ভোট নয়, নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হবে অন্য কোথাও, অন্য কোনো দেশের রাজধানীতে। এসব কথার পিঠে যে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাঁরাও সেভাবেই নির্বাচিত হয়েছেন কি না, সেকথাটি সম্ভবত তাঁরা ভুলে গেছেন।
সরকার সমর্থক একাধিক গণমাধ্যমে নানাধরণের জল্পনাও ছাপা হচ্ছে। সিঙ্গাপুর–ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে এমন কাহিনি বলা হয়েছে যে সেই কাহিনির অন্যতম চরিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন যে তিনি সিঙ্গাপুরে যাননি, থাইল্যান্ডে চিকিৎসার পর ঢাকাতেই আছেন। বিদেশিদের এসব ষড়যন্ত্রের কাহিনি প্রচারে বরং প্রশ্ন ওঠে যে ক্ষমতাসীন দল ক্রমশই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে, আস্থায় চিড় ধরেছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে পরাজয় অবধারিত বলে তারা আশঙ্কা করছে এবং সে কারণেই সুষ্ঠূ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আবশ্যিক শর্তগুলো নিয়ে সমঝোতা বা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই।
পরপর দুটো জনমত জরিপে বেশিরভাগ মানুষ দেশ ভুল পথে যাচ্ছে বলে যে মতামত দিয়েছেন, তাতে অবশ্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের আস্থায় চিড় ধরা খুবই স্বাভাবিক। প্রায় প্রতিদিনই নিত্যনতুন প্রকল্প উদ্বোধন এবং উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রচারের পরও মানুষ শুধু অর্থনীতি নিয়ে আশা হারিয়েছে, তা–ই নয়; রাজনীতির গতিপথ নিয়েও একইরকম নৈরাশ্য প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, সাড়ে ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে। প্রথমে আইআরআইয়ের জরিপে দেখা গেল ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করছে দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। আর এখন এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশ ভুল পথে যাচ্ছে।
দুই জরিপের মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়, মাত্র তিন মাসের। আইআরআই জরিপে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাজ অনুমোদনের (অ্যাপ্রুভাল) হার ৭০ শতাংশ হলেও তা যে তাঁর অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নীতির প্রতি নি:শর্ত সমর্থন নয়, তারই ইঙ্গিত দেয় জরিপ দুটির অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর। আরও তাৎপর্যপূর্ণ মতামতের প্রতিফলন দেখা যায় যখন দ্বিতীয় জরিপের উত্তরাদাতাদের ৭২ শতাংশ বলেন যে তাঁরা রাজনীতিতে এক দলের কর্তৃত্ব দেখছেন এবং ৫৫ শতাংশ এই দলটির ভূমিকাকে নেতিবাচক মনে করেন। দলীয় নেতাদের কথা থেকে জানা যায়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে। তবে জনশ্রুতি আছে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে এসব জরিপ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে করা হয়। ফলে সেগুলোয় কী ধরনের তথ্য উঠে আসে, তা আমাদের জানার সুযোগ নেই। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপই যে এগিয়ে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শতাধিক নোবেলজয়ী ও প্রায় অর্ধশতাধিক সাবেক বিশ্বনেতার খোলাচিঠিতে ড ইউনুসের মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি সুষ্ঠূ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখের বিষয়টি যে নতুন করে বিতর্ক উসকে দেবে, তা–ও মোটামুটি নিশ্চিত। ড. ইউনুসের মামলায় বিদেশি আইনজীবি ও বিশেষজ্ঞদের অভিযোগগুলোর দলিল–দস্তাবেজ খতিয়ে দেখার সুযোগ দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের প্রশ্নে তাঁদের উদ্বেগ–আহ্বান আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। তিনি বরং প্রশ্ন করেছেন, ’মিলিটারি ডিক্টেটররা যখন নির্বাচন করত তখন এই সুর কোথায় ছিল?’
অতীতের নির্বাচনের যথার্থতা এবং বিদেশিদের তখনকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। কিন্তু তাতে আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের নিষ্পত্তি হবে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক কি না, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় ভুল না থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। ভোটারদের অংশগ্রহণ অর্থবহ করার জন্য তাদের সামনে যেহেতু বেছে নেওয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে হয়, তাই সারা বছর সরকার যাদের বিরুদ্ধ পক্ষ গণ্য করল, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন কীভাবে অংশগ্রহণমূলক হবে?
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে যাঁরা খোলা চিঠি দিয়েছেন, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। তাঁরা যখন স্মরণ করিয়ে দেন যে বিগত দুটি নির্বাচনের বৈধতার ঘাটতি রয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতে এসব বিষয়ের সুরাহা কীভাবে হবে, তা দেখার জন্য বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ নজর রাখছে, তখন বিদেশিদের আগ্রহ–ঔৎসুক্য উপেক্ষা বা নাকচ করে দেওয়া মোটেও যৌক্তিক নয়; বরং নির্বাচন কীভাবে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠূ করা যায়, সেদিকেই নজর দেওয়া জরুরি।
(৩১ আগস্ট, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন