গত মঙ্গলবার ঢাকার এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অকপটে স্বীকার করেছেন, তাঁর বক্তৃতার সময়ে ’মশার দিকে নজর রাখতে গিয়ে তিনি একটি কথা বলতে ভুলে গেছেন।’ তিনি রাজস্ব কর্মকর্তাদের যে কথাটি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তা হলো, একজন কর দেবেন, আরেকজন দেবেন না, তা যেন না হয়। বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, এনবিআর ভবনে যখন অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তখন একজনকে মশা মারার ব্যাট হাতে মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জানা যায়, অর্থমন্ত্রীর মশা–আতঙ্কের কারণ হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর ডেঙ্গু হয়েছিল। ডেঙ্গুর কষ্ট তিনি তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
তারপর আরও চার বছরের বেশি কেটে গেছে; তাঁর সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, ডেঙ্গু বিস্তারের রেকর্ড করেছে। স্বাধীনতার পর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ব্যপকতায় পাঁচ শতাধিক প্রাণ হরণ করে এই রোগের জীবাণুবাহী মশককুল সারা দেশের মানুষকে অতিষ্ঠ করে রেখেছে। মন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয় ছিন্ন করে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অথচ বিষধর প্রাণী তাঁকে তটস্থ করে রেখেছে।
অর্থমন্ত্রী এ করুণ পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন? দেশের ক্ষমতায় তাঁরা একটানা ১৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন। ঢাকার বিভাজিত দুই সিটি করপোরেশনসহ সারা দেশের অধিকাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও তাঁর দলের লোকজনের করায়ত্তে। তাঁর সরকারের উন্নয়নদর্শনে বিশ্বে নজির তৈরির যে আকাঙ্খা প্রবল হয়ে আছে, তাতে মশার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর কথা ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। চার বছর আগে মশারা তাঁর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলেও ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের রুপকল্প তৈরির চাপে মশকমুক্তির কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তাঁর সরকারের আর হয়ে ওঠেনি।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনেই জানা গেল, মশক নিবারণী দপ্তর নামে একটি দপ্তরের সন্ধান পেয়ে সেখানে গিয়ে প্রতিবেদক দেখলেন, প্রায় আড়াই শ কর্মীর ওই দপ্তরের মশা মারার ওষুধ কেনা, মজুত করা কিম্বা ছিটানোর ক্ষমতাও নেই। দপ্তরটি নাকি অনেকটা সিটি করপোরেশনের আধা–গুদাম, আধা–ডাকঘরে পরিণত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন অবশ্য কী গুদামজাত করে তার বিস্তারিত কোথাও পেলাম না। সেটা কি নিজেদের দায়িত্ব নাগরিকদের কাঁধে চাপানোর স্মার্ট প্রযুক্তি বাসাবাড়িতে লার্ভা খুঁজে জরিমানা আদায়ের ড্রোন মজুতের জন্যে, না কি বিটিআই নামে জালিয়াতির মাধ্যমে সরবরাহ করা কথিত মশানাশক রাখতে, তা নগর কর্তৃপক্ষের কেউ জানলেও জানতে পারেন। তবে না জানার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওযা যায় না। উত্তরের মেয়র স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে নিয়ে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে যে বিটিআই প্রয়োগের উদ্বোধন করলেন, সেটি আসল না নকল, তা তিনি তখন জানারও চেষ্টা করেন নি। মশার কামড় যে ক্ষতিকর, তা নাগরিকদের জানানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশিত পুস্তিকা স্তুপ করার কাজেও অবশ্য ওই গুদামের দরকার হয়ে থাকতে পারে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এখন ঘটা করে ঘোষণা দিয়েছে যে বিটিআই আমদানির জালিয়াতির জন্য সরবরাহকারী কোম্পানিকে তারা ভবিষ্যতের সরবরাহ কাজে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু করপোরেশনের কাউকে নিষিদ্ধ করা কিম্বা বরখাস্ত করার কথা শোনা যায়নি। যার মানে হচ্ছে, তাঁরা কোনো দায় স্বীকার করছেন না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যাঁর বা যাঁদের এসব বিষয়ে দায় নিয়ে জবাবদিহি করার কথা, তাঁদের কোনো দায় নেই, সব দায় অন্যদের। ঢাকা দক্ষিণ মশা মারতে কী ধরণের কামান ব্যবহার করছে, তার কোনো খবর অবশ্য পত্রিকার পাতায় চোখে পড়েনি।
মশার ভয়ে অর্থমন্ত্রীর যে দশা, দশ বছর ধরে হামলা–মামলায় ক্ষয় হতে থাকা বিএনপির হঠাৎ চাঙ্গা ভাবে তাঁর সহকর্মীদেরও যে একই অবস্থা হয়নি, সেকথা বোধহয় আর বলা যাবে না। বিএনপি যতই বলে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, ততই মন্ত্রীরা বলেন, সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সম্প্রতি এ ষড়যন্ত্রে বিদেশিদেরও নানারকম অভিসন্ধি আর ভূমিকার কথা উঠছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেওয়াই বিদেশিদের চক্রান্তের কারণ বলেও দাবি করা হচ্ছে। দেশের রাজনীতির চেয়ে কখনো কখনো ভুরাজনীতিই যেন দেশের ভাগ্য নিধরারণ করবে – এমন ধারণাও তৈরি হচ্ছে।
দেশ–বিদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা যুক্তি দিচ্ছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য
যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা যদি চাপ প্রয়োগ করে তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। কেউ কেউ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিএনপি–জামাত ক্ষমতায় ফিরলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। সোজা কথায় এর মানে দাঁড়ায়, তাঁদের ধারণা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারাবে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট ভেঙ্গে গেছে বেশ কয়েক বছর। গুঞ্জন উঠেছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াতকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহ দিচ্ছে, যাতে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা সহজ হয়।
তৃতীয় ভয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকের বেলায় বরং সবচেয়ে বড় ভয় যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার ভয়। গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ১৪ লাইনের এক ঘোষণায় ’বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থনে’ ’গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে’ তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দেন। তার পর থেকে রাজনীতিতে ভিসার ভয় একটি বড় প্রভাবক হয়ে আছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাতে প্রয়োগ না হয়, সে জন্য ভারত কূটনৈতিক মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলেও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।
আগামী মাসের গোড়ার দিকে দিল্লিতে জি–২০ জোটের শীর্ষবৈঠকের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বিষযটি যাতে উত্থাপন করেন, সে জন্য ভারতীয় বিশ্লেষকেরা তাঁদের সরকারকে তাগিদ দিয়ে চলেছেন। ভারতের নীতিনির্ধারকদের এই মনোভাব মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। ভারত সরকার যে তাদের জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষে সাধ্যমত চেষ্টা করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ২০১৩ সালে তাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কথা নিশ্চয়ই আমরা বিস্মৃত হইনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই তথ্য যেমন না জানার কথা নয়, তেমনই ভারতের উদ্বেগ ও ভাবনার কথাও তাদের বিবেচনার বাইরে থাকার কথা নয়। এসব ইতিহাস ও উদ্বেগ বিবেচনায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র তার বাংলাদেশ নীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কূটনীতিকেরা নানা আলাপচারিতায় স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁরা মনে করেন গণতন্ত্র না থাকলে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি আরও বেশি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নকে বাইডেন প্রশাসন সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো ঘটনা বন্ধের লক্ষ্যে তারা র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে প্রায় বছর দুয়েক হলো। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণ হলো নিষেধাজ্ঞায় বিচারবহির্ভূত এসব কাজ বন্ধ হয়েছে। এরপর রাজনৈতিক অধিকার ফেরাতে সহায়তার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণাতেও তারা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও ঢাকায় নির্বাচনী জনসভার অনুমতি পায়নি, গত চার বছরেও সভা–সমাবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু গত মে মাসের পর পরিবেশ বদলে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাইরের কোনো দেশের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে – এমন নজির খুব একটা পাওয়া যাবে না। তার ওপর যে নীতিতে দৃশ্যমান ফল মিলছে বলে তাদের বিশ্বাস এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, সেই নীতি নির্বাচনের আগেই তারা বাদ দেবে বা বদলে ফেলবে কেন, সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য ভারতীয় বিশ্লেষকেরা দেন নি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও তাদের সহযোগীদের তাই বিদেশি বন্ধুদের ওপর ভরসা করার চেয়ে নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হওয়াই বরং ভালো।
(২৪ আগস্ট, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন