সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অশ্রুপাতের বদলে গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ হোক


সমাজে যাঁদের নিরাপত্তা দেবার কথা সেরকম একটি বাহিনীর সদস্যদের হাতে প্রিয়জনকে হত্যার মুর্হুতগুলো টেলিফোনে শোনার কষ্ট অবর্ণনীয় সন্দেহ নেই। নিহত একরামের পরিবারের কষ্ট পুরো দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। অবশ্য, ব্যাতিক্রমও আছে। যেমন এর মধ্যেও আমরা শুনেছি ‘এতো বড় অভিযানে দুএকটা ভুল হতেই পারে‘। আরও আছেন তাঁরা যাঁরা শুধু ম্যাজিষ্ট্রেটের তদন্তে সব সুরাহা হয়ে যাবে বলে আমাদেরকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, আমরা যাঁরা এই কান্নার রোলে অংশ নিচ্ছি তাঁরাই বা কতটা নৈতিক অবস্থান নিয়েছি? 

বিনাবিচারে হত্যার বিরুদ্ধে অশ্রুপাত করা বেশ সহজ কাজ। প্রতিবাদ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে, যদি ভয়  সমাজকে গ্রাস করে থাকে। গণমাধ্যম সেই ভীতি থেকে মুক্ত থাকবে এমনটা আশা করা অযৌক্তিক। কেননা, সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলো কেউই বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ থেকে পরিচালিত হয় না।

কিন্তু, কোনো পরিবেশেই বস্তুনিষ্ঠতার দায়বদ্ধতা এড়ানো সমীচিন নয়। একরামের মৃত্যুকালীন অডিও প্রকাশের পরও গণমাধ্যম সেই বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিচ্ছে কি? গত দুদিনের প্রধান প্রধান পত্র-পত্রিকাগুলোর খবরগুলোতে যাদেরকে সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা যাঁরা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাঁদেরকে মাদকব্যবসায়ী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সন্দেহ নেই তাঁদের ক্ষেত্রে যে মাদকব্যবসায়ী তকমাটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি এসেছে আইনশৃংখলাবাহিনীর ভাষ্য থেকে, আদালত থেকে নয়। তাহলে, বস্তুনিষ্ঠ হলে আমাদের লেখা উচিত আইনশৃংখলাবাহিনীর বর্ণনামতে অথবা সন্দেহভাজনকিম্বা কথিত মাদককারবারী। অনেকেই যে আইনশৃংখলাবাহিনীর কিছু সদস্যের ব্যাক্তিগত শত্রুতা অথবা দূর্নীতির শিকার নিরীহ মানুষ, সেরকম নজির তো ভুরি ভুরি আছে। তাদেরকে অপরাধী বানানোর দায় গণমাধ্যম কেন নেবে?

লক্ষ্যণীয়ভাবে এসব পত্রিকায় বন্দুকযুদ্ধলেখার সময় উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। নি:সন্দেহে এটা কিছুটা অগ্রগতি, যদিও এখানেও উদ্ধৃতিচিহ্নের চাইতে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বলা হলে তা আরও স্পষ্ট হতে পারে। বন্দুকযুদ্ধের ভাষ্য অন্য কোনো (নিরপেক্ষ) সূত্র থেকে যাচাই করা যে সম্ভব হয় নি, সেকথা বলতে পারলে পাঠকের জন্য তা আরও সহজ হয়।

কোনো সন্দেহভাজনকেই দোষী সাব্যস্ত করার অধিকার গণমাধ্যমের নেই। একথা এমনকি বহুল আলোচিত সাংসদ বদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সততা ও নিষ্ঠার সাথে পরিচালিত গণমাধ্যমের নিজস্ব অনুসন্ধানে যদি কারো বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় তখনও অভিযুক্ত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বলা যায়, কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত করার অধিকার আদালত ছাড়া অন্য কারো নয়। নিহত একরামের বিরুদ্ধে বছর দুয়েক আগে একটি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মাদকব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু, এখন কথা উঠেছে সেই প্রতিবেদনের সূত্র ছিল আইন-শৃংখলাবাহিনী। সংবাদপত্রের পাতাতেও একের পর এক অসংখ্য প্রতিবেদনে অনেককেই মাদক ব্যবসার গডফাদার অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু, এসব প্রতিবেদনের অধিকাংশেরই সূত্র হচ্ছে আইন-শৃংখলাবাহিনী। আইন শৃংখলাবাহিনীর তথ্য যে গ্রহণ করা যাবে না , তা নয়। কিন্তু, তার সঙ্গে যদি নিজস্ব অনুসন্ধানে নতুন কিছু যোগ না হয় তাহলে সেটি আইনশৃংখলাবাহিনীর তথ্য হিসাবেই তুলে ধরা কাম্য। তা নাহলে গণমাধ্যমের খবর অনেককেই পাঠকের কাছে অপরাধীর আসনে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

একরামের বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের পর গণমাধ্যম কি এটুকু সতর্কতা অনুসরণে সচেষ্ট হবে? নাকি শুধু অশ্রুপাত করেই আমরা ক্ষান্ত দেবো?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...