ঈদের নামাজের পর প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মোটেও স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য নয়।
উৎসবের এই দিনে সাধারণত ঈদ জামাতের পর পরিচিতজনেরা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, সাধ্যের মধ্যে
যতটা সম্ভব ভালো খাবার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। কিন্তু, বাংলাদেশের উপকূলীয়
জেলা কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে এবারে সেই অস্বাভাবিক ঘটনাই ঘটেছে। বিক্ষোভ
করেছেন রোহিঙ্গারা। বিক্ষোভ অবশ্য আশ্রয়দাতা দেশ বা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সিদ্ধান্ত
বা আচরণের বিরুদ্ধে নয়। এটি জাতিসংঘের বিরুদ্ধে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ উন্নয়ন
কর্মসূচি, ইউএনডিপি এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসনের বিষয়ে যে সমঝোতা স্মারক সই করেছে এই প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি তাদের ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে তাদের মতামত নিতে
হবে। তারা স্পষ্ট করে বলেছে প্রত্যাবাসন হতে হবে মর্যাদার সঙ্গে , যার মানে হচ্ছে জাতিগত
গোষ্ঠী হিসাবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি এবং ফূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার। এরপর তারা নিরাপত্তার
নিশ্চয়তার কথাও বলেছে। ইউএনএইচসিআর এর প্রতি তাদের খোলামেলা দাবি সমঝোতা স্মারক, এমওইউ
নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ইউএনডিপি এবং ইউএনএইচসিআর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক
সই করেছে বুধবার ৬ জুন তা এখনও প্রকাশ করেনি। বলা হয়েছে ওই সমঝোতার উদ্দেশ্য হচ্ছে
লাখ লাখ রোহিঙ্গার দেশে ফেরার পথ উন্মোচন করা। এবিষয়ে জাতিসংঘ সংস্থা দুটির পক্ষ থেকে
যতটুকু তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে মিয়ানমার নতুন চুক্তিতে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে
রোহিঙ্গাদের নিজ রাজ্য রাখাইনে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে যাতে তারা সেখানকার স্থানীয় পরিবেশ
ও অবস্থা যাচাই করে দেখতে পারেন। এতোদিন সেখানে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার ছিল
না।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ক্নুট অস্টবি ইউএন নিউজের
সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তাঁদের কাজ হচ্ছে প্রত্যাবাসন যেন নিরাপদ হয়,
সহিংসতার যেন অবসান ঘটে এবং তাদের মানবাধিকার
যাতে সুরক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন যে এটি হচ্ছে প্রথম এবং খুব গুরুত্বর্পূণ
পদক্ষেপ্,কিন্তু, বাস্তবে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ কাজটি শুরু হবে এখনই। গতবছর এটি ছিল
খুব বড় একটা সংকট – লাখ লাখ মানুষ আজ ভয়াবহ পরিবেশে বসবাস
করছেন। এবং এখন আমাদের সেরা চেষ্টাই করতে হবে যাতে তারা শেষপর্যন্ত স্বদেশে ফিরতে পারে।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি জাপানের এনএইচকে টেলিভিশনকে দেওয়া
এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন মিয়ানমার যে উদ্বাস্তুদের প্রতি তার সব দায়িত্বই পালন করছে এই
চুক্তি তার নিদর্শন। তিনি আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এই চুক্তিটি পড়ে দেখারও আহ্বান
জানান।
মিস সুচি যে চুক্তিটি পড়ে দেখতে বলেছেন সেই চুক্তিটি তিনি এবং জাতিসংঘের
দুই সংস্থার কেউই প্রকাশ করে নি। চুক্তিটির কপি পাওয়ার জন্য কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা,
এনজিও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদেরকে তা দেওয়া হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্ট
পত্রিকা গত ১২ জুন জানিয়েছে যে নেপিডোর পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র তাদেরকে জানিয়েছে যে
মিয়ানমার সরকারের আপত্তির কারণেই চুক্তিটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। পত্রিকাটি মিয়ানমারে
জিাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে তিনিও পত্রিকাটিকে বলেছেন
যে এটি প্রকাশের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।
মিয়ানমার অতীতে যেভাবে রাখাইনের এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘রোহিঙ্গা‘ পরিচিতি
অস্বীকার করে এসেছে, সেই ধারা থেকে তারা এখনও সরে আসেনি। র্সবসাম্প্রতিক এই চুক্তিটি
সইয়ের পর সুচির দপ্তর থেকে যে সংবাদ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে তাতেও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদেরকে
‘বাস্তুচ্যূত
লোকজন‘ বলে অভিহিত
করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের সাম্প্রতিকতম পর্বের শুরু গত অগাস্টে, যখন কথিত
একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরসার বিদ্রোহীদের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জবাবে সেনাবাহিনী
বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচার অভিযান পরিচালনা করে। তারপর থেকে এপর্যন্ত
সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা
সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর নিপীড়ণ-নির্যাতনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এবারে
আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা এর আগেও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং
ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নতুন করে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার
হয়েছেন। সঙ্গে আছেন প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় আগে থেকে থাকা আরও প্রায় তিন লাখেরও বেশি
রোহিঙ্গা। সুতরাং, মর্যাদার্পূণ প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘ সংস্থাটির ওপর আস্থা না
রাখতে পারাই স্বাভাবিক।
রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষর্পূণ ও বৈষম্যমূলক আচরণের দীর্ঘ ইতিহাস
সত্ত্বেও মিয়ানমারের প্রতি আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় অতীতে তেমন কোনো কঠোর পথ অনুসরণ করে
নি। কিন্তু, এবারে নৃশংসতা চরমে পৌঁছানোয় সবাই একটু নড়ে-চড়ে উঠেছেন। বিশেষ করে গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অং সান সুচির প্রতি সারা বিশ্ব যে অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে
এসেছে সরকারগঠনের পর তাঁর ভূমিকা প্রায় সমানভাবেই সবাইকে হতাশ করেছে। ফলে, মিয়ানমারে
সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি ও সেনাবাহিনীর কিছু শীর্ষকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে
ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র। পাশাচাত্যের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত দীর্ঘায়িত করছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশটির দায়ী ব্যাক্তিদের তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে আর্ন্তজাতিক
অপরাধ আদালত, আইসিসি।
স্পষ্টতই এসব পদক্ষেপের কারণে মিয়ানমার সরকার একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে।
নানাধরণের চাপ অনুভব করতে শুরু করেছেন দেশটির নেতারা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও রাখাইন রাজ্যের
সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো
পদক্ষেপ না নিয়েই গত ৩১ মে সুচি নতুন আরেকটি কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। এবারের
কমিশনের কাজ হবে কথিত মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করা। বোঝাই যাচ্ছে এর উদ্দেশ্য
হচ্ছে আইসিসির তদন্তের উদ্যোগকে বিভ্রান্ত করে তা ঠেকিয়ে দেওয়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
নতুন কমিশন গঠনের এই উদ্যোগকে ধোঁকা অভিহিত করে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে
যে তারা যেন দেশটির অপরাধ বিচারের জন্য আইসিসিতে পাঠায়।
এরকম পটভূমিতে জাতিসংঘ সংস্থা দুাটর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি যে মিস
সুচির জন্য একটা মূল্যবান উপহারে পরিণত হবে না তার নিশ্চয়তা কি? এনএইচকে কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
তো সেরকম আলামতই মিলছে?
সবচেয়ে গুরুত্বর্পুণ হচ্ছে বিক্ষোভকারী রোহিঙ্গাদের দাবি – যে চুক্তি
তাঁদের নিরাপদ, মর্যাদার্পূণ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সেই সমঝোতায় তাঁদের মতামত উপেক্ষা
কোন যুক্তিতে? একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ওপর এধরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো
গণতন্ত্রসম্মত নয়।
( ১৭ জুন, ২০১৮ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন