রাশেদ সোহরাওয়ার্দী, আওয়ামী
লীগের আদর্শিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে। স্থায়ীভাবে লন্ডনে আবাস
গড়লেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং
আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা ব্রিটেনে এলে তাঁদের সঙ্গে তাঁর প্রতিবারই যোগাযোগ
হয়। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের বাসভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের এক সংবর্ধনা
অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তবে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা খুব বেশি হয়নি।
১৩ জুন প্রথম সুযোগ হলো তাঁর কিছু কথা শোনার। কতিপয় সহানুভূতিশীল ব্রিটিশ
রাজনীতিকের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর জন্য আয়োজিত এক মতবিনিময়
সভায় রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর বক্তব্যই ছিল সবচেয়ে তীব্র এবং সমালোচনামূলক। ব্রিটিশ
পার্লামেন্টের একটি কমিটি কক্ষে আয়োজিত ওই সভায় তিনি আেক্ষপ করে বলেন যে
আওয়ামী লীগে তাঁর বাবার কথা এখন আর কেউ উচ্চারণ করেন না। যে চার মূলনীতি গণতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ওপর দলটি প্রতিষ্ঠিত, তাঁর বাবা বেঁচে
থাকলে সেই নীতিগুলোর প্রতি তিনি অবিচল থাকতেন। রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন,
‘কার্যকর বিরোধী দলহীন নির্বাচন’ গণতন্ত্রের পরিপন্থী এবং বাংলাদেশ এখন সে রকম এক
পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। তাঁর মতে, দ্রুত বিরোধী দলকে নিয়ে নির্বাচন করা না হলে
বাংলাদেশ আবারও ১৯৭৫-এর মতো একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের রূপ নেবে। তিনি আরও
বলেন, ‘আমি আজীবন আওয়ামী লীগ করি, কিন্তু বাকশালকে তখন যেমন সমর্থন করিনি, এখনো
তেমনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রত্যাশা করি না।’
পেশাদার কূটনীতিক থেকে রাজনীতিতে আসা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসব সমালোচনার জবাব
না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে এগিয়ে এসে সভার
অন্যতম আয়োজক হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস সোহরাওয়ার্দীপুত্রকে প্রবোধ দিয়ে বললেন,
‘আমরা কিন্তু আপনার বাবাকে সব সময়ই “গণতন্ত্রের মানসপুত্র” বলে সম্বোধন করে
থাকি।’ একজন কূটনীতিকের এই কূটনৈতিক ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগের পরিবারতান্ত্রিক
ভাবমূর্তির যে নিরসন ঘটে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ ও
অনুশীলন করতে না পারার এই সংকট থেকে বর্তমানের আওয়ামী লীগ আদৌ বেরোতে চায় কি না,
সেটিও অবশ্য একটা বড় প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে দলের যে জন্ম-ইতিহাস লেখা আছে, সেই বিবরণীর বয়ানে বলা
হয়েছে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা ঢাকার কে এম দাস
লেনের রোজ গার্ডেনে সম্মিলিত হয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার নামকরণ করা
হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খানকে দলের সভাপতি ও শামসুল হককে দলের
সাধারণ সম্পাদক করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান হন দলের যুগ্ম সম্পাদক।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের প্রক্রিয়ায় পরে দলের নাম থেকে মুসলিম কথাটি বাদ
দেওয়া হয়। যাঁর আদর্শের অনুসারীরা এই দল গঠন করলেন, তিনি কিন্তু তখন দলের নেতৃত্বে
ছিলেন না। যদিও পরে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
হয়েছিলেন। বৈরুতে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু না হলে দলের ওপর তাঁর প্রভাব হয়তো আরও
বিস্তৃত হতো।
আওয়ামী লীগের আদর্শিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশিত গণতান্ত্রিক চেতনার অবক্ষয়ে
তাঁর পুত্রের আেক্ষপের হয়তো তেমন একটা গুরুত্ব নেই। কারণ, তিনি লন্ডন–প্রবাসী এবং
দেশে দলীয় কার্যক্রমে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই, যেমনটি আছে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের।
সম্ভবত সে কারণেই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা যায়, ‘আওয়ামী লীগের
প্রতিষ্ঠা হয়েছে এই ওসমান পরিবারে। এখানে দল গঠন থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে।
রাজনীতির নীতি-আদর্শ নিয়ে চলতেন জোহা কাকা। এই পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক
ছিল সব সময়। যদি তাদের প্রয়োজন হয়, দেখাশোনা করব’ (সমকাল, ৪ জুন, ২০১৪)।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ওসমান পরিবারের ক্ষমতার মাহাত্ম্য টের পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক সাত খুনের ঘটনায় এই পরিবারকে ঘিরে আবারও বিতর্ক তৈরি
হওয়ার পটভূমিতেই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এই সাফাই। রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর
আেক্ষপ আর ওসমান পরিবারের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন—এ দুই মন্তব্যের দৃশ্যমান
বৈপরিত্য নিঃসন্দেহে একটি ভাবনার বিষয়।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা আন্দোলনের দল এবং তার অর্জনও অনেক। কিন্তু শুধু অতীতের
অর্জন আর ঐতিহ্যের ওপর ভর করে একটি
দল যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থায় অনন্তকাল ধরে তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে না,
তার সাম্প্রতিকতম নজির হচ্ছে ভারত। ভারতের স্বাধীনতা এনেছে যে রাজনৈতিক দল, সেই
কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণগুলো খতিয়ে দেখলে তা থেকে বাংলাদেশেরও অনেক কিছু শেখার
আছে। দেশটিতে এই প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও কৃতিত্বের রাজনৈতিক পুঁজি
ভোটের বাজারে কোনো কাজে আসেনি। স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে
থাকা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো দল যদি কতিপয় ব্যক্তি, পরিবার
ও গোষ্ঠীর স্বার্থের নিগড়ে বন্দী থাকে, তাহলে সেই দলের বিকাশ রুদ্ধ হতে বাধ্য।
তাই আওয়ামী লীগেরও সম্ভবত এখন প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ, তাদের ৬৬ বছরের ইতিহাসের
নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা। সেকাল ও একালের আওয়ামী লীগের ফারাকগুলো, আদর্শ ও
মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের গুণগত দিকের ক্ষেত্রে—এই সবকিছুরই বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন
প্রয়োজন।আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও দলের মূল্যায়নকে অনেকেই দুই ভাগে ভাগ
করে থাকেন। একটি হচ্ছে ’৭৫-পূর্ব আওয়ামী লীগ আর অপরটি ’৭৮-উত্তর। স্বাধীনতাযুদ্ধের
ভূমিকা দলের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু শুধু সেই অর্জনই কি দলের একমাত্র
পাথেয় হয়ে থাকতে পারে? ’৭৫-এ বাকশাল গঠনের সময় আওয়ামী লীগের বিলুপ্তিকে অনেকে একটি
অধ্যায়ের অবসান হিসেবে গণ্য করার যে দাবি করে থাকেন, তা বিবেচনায় না নিলেও যে
সত্যটি অনস্বীকার্য তা হলো, আওয়ামী লীগ বলতে এখন যা বোঝায়, সেই রাজনীতির রূপকার
হলেন শেখ হাসিনা। তিনি একটানা প্রায় ৩৩ বছর দলের সভানেত্রী, যেটি বৈশ্বিক পরিসরেও
যেকোনো রাজনীতিকের জন্য একটি রেকর্ড বলে গণ্য হবে। সুতরাং দল হিসেবে একালের
আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা অংশগ্রহণমূলক কিংবা
নির্দেশনামূলক যাই হোক, তার দায় বা কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। দল যদি গুটিকয় ব্যক্তি ও
গোষ্ঠীস্বার্থের রক্ষক হয়ে থাকে কিংবা সুবিধাবাদ ও পেশিশক্তির পূজারি হয়ে থাকে,
সেই দায়ও শেখ হাসিনারই। দলের অভ্যন্তরে বিকল্প নেতৃত্বের উন্মেষ অথবা গণতন্ত্র
চর্চার উদ্যোগ কোনোটিই যে সুখকর হয়নি, তার নজিরও অগণিত। দলের অভ্যন্তরে
গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাব করে নাকাল হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের হয় দল ছাড়তে
হয়েছে, নয়তো পরিণতি হয়েছে নেত্রীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।দলীয় নেতৃত্বের ৩৩ বছরের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার
সুযোগ পেয়েছেন ১০ বছরেরও বেশি। সরকার পরিচালনায় তাঁর অনেক অর্জনও হয়তো আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্রোহের অবসান তার মধ্যে
নিঃসন্দেহে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারও হতে পারত সে
রকম আরেকটি অর্জন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা রাজনৈতিকীকরণের দূষণে অনেকটাই বিতর্কিত হয়ে
পড়েছে। তবে, তাঁর অন্য সব অর্জনই ম্লান হতে চলেছে যে কারণে, তা হলো ক্ষমতা
আঁকড়ে থাকার বেপরোয়া চেষ্টায় রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বর্ণিত ‘গণতন্ত্রের পরিপন্থী
কার্যকর বিরোধী দলহীন নির্বাচন’।৫ জানুয়ারি ভোটারদের বঞ্চিত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন
নির্বাচনকে বৈধ বলে যাঁরা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছেন, তাঁরা বিস্মৃত হচ্ছেন যে অতীতে
একাধিকবার সামরিক শাসনও আদালতের অনুমোদন পেয়েছে। সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা এবং
আইনগত বৈধতার পাশাপাশি গণমানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কোনো অংশেই কম
গুরুত্বপূর্ণ নয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করার দায় দেশের প্রাচীনতম এই দলটির
কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার অপবাদ চিরস্থায়ী হওয়ার বিষয়টি এখন শেখ হাসিনার জন্য প্রায়
অবধারিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষত কি তিনি আরও বিস্তৃত হতে দেবেন, নাকি তা দ্রুত
সারিয়ে তুলতে বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজবেন?১৩ জুনের ওই সভায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ব্রিটিশ এমইপি
চার্লস ট্যানক বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কোনো খবর যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে
শিরোনাম হচ্ছে না, সেটাই ভালো খবর। রানা প্লাজা ধস এবং রাজনৈতিক সহিংসতার মতো
নানা ধরনের বীভৎসতার খবর শুনে অভ্যস্ত চার্লস ট্যানকের মতো রাজনীতিকেরা চান না যে
বাংলাদেশ থেকে আবারও কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা সংবাদে উঠে আসুক। রাষ্ট্রপতি আবদুল
হামিদের সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিবের বৈঠকেও তাই রাজনৈতিক সংলাপের কথা এসেছে। কিন্তু
জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁকে বলেছেন, ৫
জানুয়ারির নির্বাচন সবাই মেনে নিয়েছে এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে পাঁচ বছর পর
সংলাপ হবে। রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যে যদি প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে
থাকে, তাহলে তাকে দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে। এই দুর্ভাগ্য যেমন দেশের, তেমনি তা
আওয়ামী লীগেরও।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন