সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইন্টরনেটে ইচ্ছে হলেই বন্ধের নীতি কাম্য নয়


মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে ইন্টারনেটে দুটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটের পথে প্রতিবন্ধক বসিয়ে কয়েকঘন্টা পরই তা আবার সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিটিআরসি। একটি হচ্ছে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ষ্টার, আর অপরটি ওয়েবভিত্তিক বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। প্রথমটিতে পত্রিকাটির অনলাইন পোর্টালে প্রবেশপথ বন্ধ করা হয় ২ জুন এবং সারাদিন পর রাতের বেলা তা প্রেত্যাহার করে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রেও দিনের প্রথমভাগে একই পন্থা অবলম্বন করে রাতের বেলায় তা সরিয়ে নেওয়া হয়। ডেইলি স্টার সরকারীমহলে বহুদিন ধরেই সমালোচিত এবং বিভিন্ন গুরুত্বর্পূণ সরকারী প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রবেশাধিকারও নিয়ন্ত্রিত। তবে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ঠিক তার বিপরীত, সরকারীমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত এবং সরকারের অনেক দপ্তরেই অন্যদের তুলনায় তাদের জন্য দরোজা অধিক প্রসারিত।

এই দুটি বিপরীতধর্মী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এধরণের অস্বাভাবিক আচরণের কারণ সরকারীভাবে যেহেতু বলা হয় নি, সেহেতু আমরা তা জানি না। তবে, তাতে করে অনুমান করা থেকে তো কেউ আমাদের বিরত রাখতে পারে না। এবং লক্ষ্যণীয়ভাবে জনমনের অনুমানে কোনো তারতম্য নেই। সবাই ধরে নিয়েছেন সরকার চায় না এমন কোনো তথ্য বা মতামত প্রকাশের কারণেই এই ব্যবস্থা। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের দাপটে অতিষ্ঠ সবাই যখন নতুন প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক বিধিবিধানের আশংকায় উদ্বিগ্ন তখনই এধরণের অনাকাঙ্খিত পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তি ঘটলো।  

এতো অল্পসময়ের মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করে নেওয়া এধরণের পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তির পর প্রশ্ন উঠেছে সরকার কি তাহলে ইচ্ছে হলেই বন্ধ করারনীতি গ্রহণ করেছে? সাধারণভাবে প্রচলিত রীতি হচ্ছে কারো বিরুদ্ধে কোনোধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে সে কি অপরাধ করেছে সেটা তাকে জানাতে হয়। অনেকসময়েই ভুল এবং অপরাধ এর মধ্যে পার্থক্য না টেনে তালগোল পাকানোর কারণে অনেককেই নিরীহ ভুলের জন্যও মাশুল গুণতে হয়। কিন্তু, অপরাধ না করলেও কাউকে অপরাধীর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে অবিচার। সেকারণেই শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধীকে তার অপরাধের অভিযোগটা জানিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া সমাজের সভ্যতার নির্দেশক। এই দুটো ক্ষেত্রেই যাদের ওয়েবসাইটের পথে প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়েছিলো তাদেরকে কিছুই জানানো হয়নি। দেশের একজন নাগরিকের বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে তাকে কিছু না জানিয়েই কর্তৃপক্ষ দেওয়াল তুলে দিলে যে অবস্থা দাঁড়ায় এই দুটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। অবশ্য, এর আগেও ঠুনকো অজুহাতে বিভিন্ন সংবাদিভিত্তিক পোর্টাল বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। বছর দুয়েক আগেই বন্ধ করা হয়েছিল ৩৫টির মত পোর্টাল। তবে, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কাহিনী প্রচারের জন্য সুপরিচিত কোনো পোর্টাল বন্ধ হয় নি।

ইন্টারনেট সেবাব্যবস্থায় গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে আইআইজি এবং মোবাইল টেলিফোন সেবাদানকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাঁদেরকে যে নির্দেশ দেয় তাঁরা তা মানতে বাধ্য, না মানলে ব্যবসা করার অনুমতিই বাতিল হয়ে যেতে পারে। উভয়ক্ষেত্রেই এসব আইআইজি এবং মোবাইল কোম্পানিকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়েই ওয়েবপোর্টালগুলোর ঠিকানা দিয়ে সেগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটির পর নিউ এজ পত্রিকা টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারকে উদ্ধৃত করে বলেছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে বিটিআরসি আইজি এবং মোবাইল কোম্পানিকে ওই নির্দেশ দিয়েছিল। বিটিআরসি চেয়ারম্যানও পত্রিকাটিকে সরকারী সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। মন্ত্রী এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যানের বক্তব্যে সরকারী সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত হওয়া গেলেও তার কারণটি জানা গেল না। কোন অপরাধের কারণে অথবা কোন বিবেচনায় তথ্যপ্রবাহে এধরণের প্রতিবন্ধক তৈরির সিদ্ধান্ত এবং কোন যুক্তিতে তা কয়েকঘন্টার মধ্যেই প্রত্যাহার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ায় এটা স্পষ্ট যে জনমনে যে ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাহোল সরকার এমন কিছু প্রকাশের বিপক্ষে যাতে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। ডজন ডজন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স এবং শত শত পত্রিকা প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার নিজেকে গণমাধ্যমবান্ধব প্রমাণের যে চেষ্টা চালিয়ে আসছে এধরণের পদক্ষেপ স্পষ্টতই তার বিপরীত। বরং, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের অভিযোগ এতে আরও জোরদার হলো।

এরপর যে প্রশ্নটি উঠছে তাহোলে এসব পোর্টালের পথে যে বাধা তৈরি করা হয়েছিল তা সরিয়ে নেওয়া হলো কেন? সরকারের প্রথম পদক্ষেপটি ভুল ছিল বলেই কি তা শোধরানোর চেষ্টা? সেরকমটি হলে তো  ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে সরকারের দু:খপ্রকাশ করা উচিত। সেরকম কিছু কি হয়েছে? বা সরকার কোনোধরণের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? নাকি, ওইসব প্রতিষ্ঠান সরকারের চাপের মুখে কিছু ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে? পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার জন্য এসব প্রশ্ন মোটেও কম গুরুত্বর্পূণ নয়। প্রতিটি পাঠকের জানার অধিকার রয়েছে কেন সে তার পছন্দের পোর্টালে ঢুকতে পারলো না? আবার, নাগরিক হিসাবেও তার অধিকার রয়েছে কেন সরকার এধরণের একটি পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানার।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে পাঠক বা নাগরিক কোনো পরিচয়েই কারো কাছ থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে নিরুত্তর থাকলেও  নাগরিকরা কিন্তু ঠিকই উত্তরটা পেয়ে যান। অবশ্য সেই উত্তরটা যেহেতু সুখকর নয়, সেহেতু রাজনীতিকরা যে তা শুনতে আগ্রহী হবেন না সেটাই তো স্বাভাবিক।

বিরুপ জনপ্রতিক্রিয়ার কারণে সরকার যদি তার সিদ্ধান্ত বদলে থাকে তাহলে সম্পাদক এবং সংবাদকর্মীদেরও এধরণের নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ মোকাবেলার বিষয়টি নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। আপোষ কিম্বা স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ-সেন্সরশিপের পিচ্ছিল পথে পা বাড়ানো হলে তা হবে পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসা। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মন্তব্যসমূহ

  1. Dear Kamal Bhai, Thank you very much for your nice article about Web portal and Internet. Basically, to many in the media, Internet governance seems to be an issue far removed from their daily life and work. This misconception can have substantial consequences. The Internet is fast becoming the infrastructure for all communications between media and citizens. If journalists and media freedom activists do not get involved in the debates about how to govern the net, it will be left to governments and private companies to define the rules for our public arena. So now need to understand about Media and Internet Governance in Bangladesh and region and International arena inline with Governing the Internet means governing the media, Fundamental rights still apply—but how to enforce them on the net? Internet governance and the media in practice, Journalists have to make their voices heard, New stakeholders, new conflicts—a new power balance? Our public arena is at stake.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...