সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইচ্ছে হলেই বন্ধ, এ কেমন নীতি

যেসব ধরনের হয়রানির আশঙ্কা নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাবিত খসড়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল, তা নিরসন করার আশ্বাস দিয়েছিলেন একাধিক মন্ত্রী এবং সংসদীয় কমিটি। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের ভোগান্তি তো আর কম হয়নি। মাত্র কয়েক দিন আগে সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকেও এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে ইন্টারনেটে দুটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটের পথে সাময়িকভাবে প্রতিবন্ধক তৈরি করে সরকার সেই আশঙ্কাই আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ওই দুটি সংবাদমাধ্যমের একটি হচ্ছে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, আর অপরটি ওয়েবভিত্তিক বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। প্রথমটির অনলাইন পোর্টালে প্রবেশপথ বন্ধ করা হয় ২ জুন এবং পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রেও ১৮ জুন একই ধরনের পদক্ষেপ নেয় বিটিআরসি।
সরকারি মহলে বহুদিন ধরেই সমালোচিত ডেইলি স্টার। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহের অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। বিপরীতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর সরকারি মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। এই দুটি বিপরীতধর্মী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এ ধরনের অস্বাভাবিক আচরণের কারণ সরকারিভাবে যেহেতু বলা হয়নি, সেহেতু আমরা তা জানি না। তবে সে জন্য অনুমান করা থেমে নেই। সরকার চায় না এমন কোনো তথ্য বা মতামত প্রকাশের কারণেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেই সবার ধারণা। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপের দিনের খবরগুলো যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই খবরের গুরুত্ব বুঝে সেগুলো অনেক সময়েই সংরক্ষণ করে থাকেন। আবার ইন্টারনেটে প্রকাশিত যেকোনো তথ্য যেহেতু পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না, সে কারণেও একটু খোঁজখবর করলে মানুষ ঠিকই জানতে ও বুঝতে পারে। এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এত অল্প সময়ের মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ করে নেওয়া এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ‘ইচ্ছে হলেই বন্ধ করার নীতি’ অনুসরণের আলামত দেখা যাচ্ছে বলেই অনেকের ধারণা। সাধারণভাবে প্রচলিত রীতি হচ্ছে, অপরাধীকে তার অপরাধ কী, তা জানিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েই তাকে শাস্তি দেওয়া। অনেক সময়েই ‘ভুল’ এবং ‘অপরাধ’ এর মধ্যে তালগোল পাকানোর আশঙ্কা থাকে এবং সে কারণেই নিরীহ কাউকে যাতে ভুলের মাশুল গুনতে না হয়, সে জন্যই এই রীতি। এই দুটো ক্ষেত্রেই যাদের ওয়েবসাইটের পথে প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়েছিল, তাদের কিছুই জানানো হয়নি। অবশ্য এর আগেও ঠুনকো অজুহাতে বিভিন্ন সংবাদভিত্তিক পোর্টাল বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। বছর দুয়েক আগেই বন্ধ করা হয়েছিল ৩৫টির মতো পোর্টাল। তবে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষক ও সরকার সমর্থক হিসেবে সুপরিচিত কোনো পোর্টাল বন্ধ হয়নি।
টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট সেবাব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বিটিআরসি। এই খাতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সেবা দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এবং মোবাইল ফোন কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের যে নির্দেশ দেয় তারা তা মানতে বাধ্য, না মানলে ব্যবসা করার অনুমতিই বাতিল হয়ে যেতে পারে। ডেইলি স্টার এবং বিডিনিউজ—উভয় ক্ষেত্রেই কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়েই এসব আইআইজি এবং মোবাইল কোম্পানিকে ওয়েব পোর্টালগুলোর ঠিকানা দিয়ে সেগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে সরকারের নির্দেশের কথা বলা হলেও তার কোনো কারণ উল্লেখ নেই।
দ্বিতীয় ঘটনাটির পর নিউ এজ পত্রিকা টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে উদ্ধৃত করে বলেছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে বিটিআরসি আইআইজি এবং মোবাইল কোম্পানিকে ওই নির্দেশ দিয়েছিল। বিটিআরসি চেয়ারম্যানও পত্রিকাটিকে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। মন্ত্রী এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান সরকারি সিদ্ধান্তের কথা বললেও কারণটি জানাননি। সুতরাং কোন অপরাধের কারণে অথবা কোন বিবেচনায় তথ্যপ্রবাহে এ ধরনের প্রতিবন্ধক তৈরির সিদ্ধান্ত এবং কোন যুক্তিতে তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রত্যাহার—তা এখনো রহস্যাবৃত। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে মন্ত্রী ও বিটিআরসির কোনো ভূমিকাই কি নেই?
সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এমন কিছু প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তা যে খুব একটা সফল হয়েছে—সে কথা বলা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিক্রিয়ায় তেমন ধারণাই মেলে। ডজন ডজন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স এবং শত শত পত্রিকা প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার নিজেকে গণমাধ্যমবান্ধব প্রমাণের যে চেষ্টা চালিয়ে আসছে, এ ধরনের পদক্ষেপ স্পষ্টতই তার বিপরীত। এ ধরনের পদক্ষেপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের অভিযোগ আরও জোরদার হলো।
প্রশ্ন উঠেছে, এসব পোর্টালের পথে যে বাধা তৈরি করা হয়েছিল তা সরিয়ে নেওয়ার কারণ কি সরকারের ভুল শোধরানোর চেষ্টা? ভুল শোধরানোর আত্মোপলব্ধি ঘটে থাকলে তার জন্য সরকার সাধুবাদ পেতে পারে। কিন্তু যেখানে কারণই জানানো হয়নি, সেখানে আত্মোপলব্ধি থেকে ভুল শোধরানোর সুযোগ কোথায়। সরকারকে সাধুবাদ দেওয়া যেত যদি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে সরকার অন্তত দুঃখ প্রকাশ করত। অন্য সম্ভাবনাটি হচ্ছে ওই সব প্রতিষ্ঠান সরকারের চাপের মুখে কিছু ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে বলেই সরকার ওই ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে। সে রকমটি হয়ে থাকলে পাঠকের তা জানার অধিকার রয়েছে। আবার নাগরিক হিসেবেও সরকারের কাছ থেকে তার নেওয়া পদক্ষেপের যৌক্তিকতা জানার অধিকার আমাদের রয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাঠক বা নাগরিক কোনো পরিচয়েই কারও কাছ থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে নিরুত্তর থাকলেও নাগরিকেরা কিন্তু ঠিকই উত্তরটা পেয়ে যান। অবশ্য সেই উত্তরটা যেহেতু সুখকর নয়, সেহেতু রাজনীতিকেরা যে তা শুনতে আগ্রহী হবেন না—সেটাই তো স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও তার অবস্থান ব্যাখ্যা করার দায় আছে। না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিপরীতে কথিত মূলধারার গণমাধ্যম তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।
বিরূপ জনপ্রতিক্রিয়ার কারণে সরকার যদি তার সিদ্ধান্ত বদলে থাকে, তাহলে সম্পাদক এবং সংবাদকর্মীদেরও এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ মোকাবিলার বিষয়টি নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। সত্য প্রকাশের পথে দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে জনসমর্থন সব সময়েই স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে। সুতরাং আপস কিংবা স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপের পিচ্ছিল পথে পা বাড়ানো হলে, তা হবে পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসা।
(২১ জুন, ২০১৮র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...