সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুলতান এরদোয়ানের নির্বাচনী বিজয়


প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গত দেড় দশক ধরে তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায়, তবে ২০১৪র আগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী । প্রেসিডেন্ট পদে এবার তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ চালাবেন। বছর দুয়েক আগে সেনাবাহিনীর অভ্যূত্থান প্রচেষ্টা শক্ত হাতে দমন করায় সফল হওয়ার পর থেকে কার্য্যত তিনি একজন অপ্রতিদ্বন্দী নেতা ছিলেন। রোববারের নির্বাচনে তাঁর সেই অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হোল।

এই নির্বাচনের আগে গতবছর তিনি সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের হাতে যেসব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন তাতে করে তাঁর ক্ষমতা ওসমানীয় যুগের সুলতানদের চেয়ে খুব একটা কম হবে না। এতোদিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে সামান্য কিছু ক্ষমতা ছিল, সেটাও প্রেসিডেন্টের কাছে ফিরে আসছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী পদটাই বিলুপ্ত হবে। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন এবং তাঁরা তাঁর কাছেই জবাবদিহি করবেন। বিচারক নিয়োগ, প্রতিরক্ষাবাহিনীর নিয়োগ এবং যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা সবই এখন তাঁর হাতে। প্রেসিডেন্ট পদে ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর একই দলের নেতা আব্দুল্লাহ গুল। কিন্তু, নির্বাহী ক্ষমতার সিংহভাগই ভোগ করতেন এরদোয়ান। এখন ক্ষমতায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ, কারো সঙ্গে তা ভাগাভাগির কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন দল একেপি ( জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলেপমেন্ট পার্টি)র প্রতিষ্ঠাতা।

উন্নয়নে ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যুক্তি দেখিয়ে যে অল্প কয়েকজন রাজনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করে তা দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টায় সফল হয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর আসনটি পোক্ত করে নিলেন। তাঁর এই লৌহমানবের ভাবমূর্তি গণতন্ত্রের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতির্পূণ নয়। গণতন্ত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হয়, জবাবদিহিতা থাকতে হয়, ভিন্নমতের একটা আলাদা গুরুত্ব থাকে। তুরস্কে এসবকিছুর অবসান ঘটেছে। দেশটিতে এখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। দুই বছর ধরে সেখানে জারি আছে জরুরি অবস্থা , তাও প্রেসিডেন্টের ডিক্রির জোরে। তবে, মন্দের ভালো সংবিধানের সংশোধনীতে দুই মেয়াদের পর প্রেসিডেন্টের বিদায় নেওয়ার কথা আছে। অন্যান্য স্বৈশাসকদের মত তিনিও যে শেষপর্যন্ত এই সংশোধনীটি বদলাবেন না তা অবশ্য কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

ব্যর্থ অভ্যূত্থানে জড়িত থাকার সন্দেহে সরকার যে শুধু সামরিকবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে ত-ই নয়, বিচারবিভাগ, পুলিশ, সরকারী দপ্তর এমনকি শিক্ষকরাও সেই অভিযান থেকে রেহাই পাননি। চাকরি হারিয়েছেন এক লাখ সাত হাজার মানুষ, যাঁদের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং তেত্রিশ হাজার স্কুল-শিক্ষক। ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানির একটি বহুলপ্রচলিত কৌশল হচ্ছে তাদেরকে স্বেচ্ছানির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইসলামপন্থী রাজনীতিক ফেতুল্লা গুলেন এর অনুসারী হিসাবে অভিহিত করা।

তুরস্ক এখন সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি রাষ্ট্র। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ চামহুরিয়াত এর সম্পাদকসহ শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের অনেককেই একাধিক মামলায় হয় আটক করা হয়েছে, নয়তো তাঁরা দেশান্তিরি হয়েছেন। তুরস্কভিত্তিক একটি সংগঠনের হিসাবে ২০১৬ সালের পর থেকে বিভিন্নসময়ে অন্তত দেড়শজন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে।

ভিন্নমত দমন এবং কর্তৃত্ববাদিতার জন্য মানবাধিকারকর্মীদের কাছে নিন্দিত হলেও দেশের ভিতরে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারার পুনরুজ্জীবনে তাঁর সাফল্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কার্য্যত, দেশটির ভিতরে এবং বাইরেও অনেকেই এখন এরদোয়ানকে ইসলামী মতাদর্শের বৈশ্বিক নেতা বলে মনে করেন। তুরস্কের উদারপন্থী নেতা হিসাবে কেমাল আতাতুর্কের যে বৈশ্বিক ভাবমূর্তি, এরদোয়ান তার সর্ম্পূণ বিপরীত। ফিলিস্তিনী সংকটে, বিশেষ করে গাযার অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর সমর্থনে ইজরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ফোরামে তাঁর অবস্থান তাঁর এই ভাবমূর্তিকে জোরদার করেছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একইধরণের ভূমিকা নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সউদি সরকারের নমনীয় অবস্থানের বিপরীতে তাঁর এই অবস্থানে ইসলামপন্থীরা অনেকটাই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন।

সিরিয়া সংকটে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূমিকাতেও স্বাতন্ত্র লক্ষ্যণীয়। এই স্বাতন্ত্রের একটি কারণ হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাকে মুকুলেই ধ্বংস করে দেওয়া। একদিকে পাশ্চাত্যের সামরিক জোট নেটোর সদস্য হিসাবে আসাদবিরোধী সামরিক তৎপরতায় তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করলেও কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রশ্নে তিনি কাউকেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি। তিনি তুর্কী জাতীয়তাবাদের কথিত পুর্নজাগরণের ধারণা তৈরি করেছেন। নির্বাচনের পর প্রথম বক্তৃতায় তিনি সর্দপে ঘোষণা করেছেন, তুরস্ক বিশ্বে গণতন্ত্রের নতুন নজির তৈরি করেছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গণতন্ত্রের যে নতুন নজিরের কথা বলছেন তা এখন আর মোটেও নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন কিম্বা ভারতে নরেন্দ্র মোদি ইতোমধ্যেই উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যা বিশ্বকে বরং আরও অস্থির করে তুলেছে। এই তালিকায় রেচেপ তাইপ এরদোয়ানের অবস্থান সেই অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দেয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তুরস্কের ইউরোপীয় প্রতিবেশিরা অস্বস্তিতে আছেন অনেকদিন ধরেই। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার শরণার্থী- অভিবাসনকামীদের ইউরোপমুখী স্রোত মোকাবেলায় তুরস্কের সহযোগিতা খুবই জরুরি। তাদের এই অস্বস্তির  আপাতত যে অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই তা মোটামুটি স্পষ্ট।

নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিরোধীদল শুরুতে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও শেষপর্যন্ত পরাজয় মেনে নিয়েছে। তবে, ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনী প্রচারে বিরোধীদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ করে এসেছেন। নির্বাচনে বড়ধরণের কোনো অনিয়ম ঘটুক আর না-ই ঘটুক কিছু কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা অনেককেই হতবাক করেছে। এরকম একটি ঘটনা ঘটে নির্বাচনের তিনদিন আগে। ভোটগ্রহণ হয়েছে রোববার, কিন্তু সরকার-সমর্থক একটি টিভি চ্যানেল ওডা টিভির পর্দায় বৃহস্পতিবার সকালেই ভোটের একটি ফলাফল দেখানো হয়। তাতে দেখা যায় মি এরদোয়ান ৫৩ শতাংশ এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দী মুহাররেম ইন্স পেয়েছেন ২৬ শতাংশ ভোট। নির্বাচনের ফল সরাসরি সম্প্রচারের প্রস্তুতি হিসাবে ওডা টিভি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলুর সরবরাহ করা তথ্য ব্যবহার করে যে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালায় তাতে এই ফল দেখা যায়। সরকারী বার্তা সংস্থার ব্যবহৃত ভোটের হার প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পাওয়া আসল ভোটের হারের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বিষয়টি অনেকের মধ্যেই নানাধরণের প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অবশ্য, তাঁর প্রতিদ্বন্দীর আসল ভোট হচ্ছে ৩১ শতাংশ।
(২৫ জুন, সোমবার প্রথম আলো অনলাইনে  প্রকাশিত লেখকের বিশ্লেষণ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...