সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অ্যাসাঞ্জের প্রতি ট্রাম্পের ভালোবাসার অবসান ?


সারা বিশ্বে আলোড়নসৃষ্টিকারী উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কারাজীবন নাটকীয়ভাবে শুরু হলো। লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাস ভবনে ঢুকে পুলিশ তাকে আটক করেছে। ব্রিটিশ আদালতের জামিন লংঘনের জন্য ২০১২ সালে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জেরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।  তবে, অ্যাসাঞ্জের একজন আইনজীবি জানিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণ  (একট্রাডিশন) অনুরোধও তাঁকে আটক  করার একটি কারণ। বৃহস্পতিবার লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে যে রাষ্ট্রদূতের অনুরোধেই পুলিশ তাঁকে দূতাবাস থেকে গ্রেপ্তার করেছে। জামিন নবায়নের জন্য তিনি আদালতে হাজির না হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইকুয়েডর দূতাবাসে এবং সেখানেই কেটেছে তাঁর সাত বছর।  কিন্তু,, এই সাতবছরে বিশ্ব রাজনীতিতে অস্যংখ্য পালাবদল ঘটেছে এবং সেগুলোর মধ্যে দুটি দেশের ক্ষমতার রদবদলের প্রত্যক্ষ প্রভাব তাঁর ওপরে পড়েছে।
এই দুটি পরিবর্তনের একটি হচ্ছে ইকুয়েডরের নির্বাচনে তাঁর আশ্রয়দাতা প্রেসিডেন্ট রাফায়েল করেয়ার বিদায়। তাঁর উত্তরসুরি লেনিন মরিনো আর অ্যাসাঞ্জের দায়ভার বহন করতে রাজি ছিলেন না। তারই পরিণতি এই রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিলের সিদ্ধান্ত। বলা চলে, ফেরারি অ্যাসাঞ্জকে তিনিই এখন ব্রিটিশ পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছেন। রাফায়েল করেরা তাঁর উত্তরসুরির সিদ্ধান্তের নিন্দাও করেছেন।   
দ্বিতীয় যে পালাবদলের ঘটনাটি গুরুত্বর্পূণ এবং আলোচিত তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টতই অ্যাসাঞ্জের হ্যাকিংয়ে লাভবান হয়েছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দী হিলারি ক্লিন্টনের ইমেইল ফাঁস করার ঘটনা ছিল ২০১৬র নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিকবার নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রশংসা করেছেন। অথচ, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁসের অভিযোগে  অ্যাসাঞ্জ ছিলেন অভিযুক্ত আসামী। এবং, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিচারের জন্য তাঁকে যাতে তুলে দেওয়া না হয় সেজন্যেই তিনি ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি এখন আর বলবেন আই লাভ অ্যাসাঞ্জ ( অ্যাসাঞ্জকে আমি পছন্দ করি /ভালোবাসি) ?
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে প্রথম যে মামলায় গ্রেপ্তার, জামিন এবং তা লংঘনের  ঘটনাগুলো ঘটেছে সেই মামলাটি ছিল সুইডেনে একজন নারীকে ধর্ষণের মামলা। সেই মামলায় সুইডেন তাঁকে তাদের আদালতে বিচার করতে চেয়েছিল এবং অভিযুক্তকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু, সেই অভিযোগ পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু, ইত্যবসরে যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।  প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে রাশিয়ার ভূমিকার বিষয়ে মূলারের তদন্তসূত্রে এই মামলার কথা ফাঁস হয়ে গেছে।  সুতরাং, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের সম্ভাবনা এখন প্রবল। আগেও তিনি আশংকা করেছিলেন যে সুইডেন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বললেও তাঁরা আসলে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তুলে দেবেন। 
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার যেসব প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে: একটি দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পর তা কোনোধরণের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া বাতিল করতে পারে কি? আশ্রয় যদি শর্তসাপেক্ষ হয়ে থাকে, তাহলে শর্ত লংঘনের অভিযোগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তা বাতিল করা আর্ন্তজাতিক আইন সমর্থন করে কি ?
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষজ্ঞরা গ্রেপ্তারের আশংকায় ইকুয়েডর দূতাবাসে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টি আর্ন্তজাতিক আইনে সমর্থনযোগ্য নয় বলে এর আগে একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছেন। সংস্থার ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন গত ডিসেম্বরের ২১ তারিখেও একটি বিবৃতিতে তাঁকে অবাধে দূতাবাস থেকে বেরিয়ে মুক্তভাবে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। অ্যসাঞ্জের আইনজীবি ব্যারিস্টার জিওফ্রে রবার্টসন অ্যসাঞ্জের আশ্রয় বাতিলের জন্য ইকুয়েডরের সমালোচনা করে বলেছেন যে দেশটি আর্ন্তজাতিক আইনের পরিপন্থী কাজ করেছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বিভিন্ন গোষ্ঠীও এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে। রুশ সরকারের মুখপাত্র গ্রেপ্তারের নিন্দা করে অ্যাসাঞ্জের মানবাধিকার যাতে লংঘিত না হয় সেই আহ্বান জানিয়েছেন।
সন্দেহ নেই, অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকসের কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের অনেক দেশের খ্ষতির কারণ হয়েছে। বিশেষ করে তা ওইসব দেশের অনুসৃত বিভিন্ন নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিব্রত করেছে। আর্ন্তজাতিক জনমত ও আইন উপেক্ষা করে পরিচালিত ইরাক যুদ্ধের কারণে  যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে অ্যাসাঞ্জ বিপুল জনসমর্থন পেয়েছেন। বলা চলে, বিশ্বের সবেচেয়ে শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে তিনি অভূতর্পূব সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু, ২০১৬ তে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময়ে তাঁর কার্যক্রম স্পষ্টতই বহুলবিতর্কিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচন জিততে সহায়তা করেছে। এই পক্ষপাত অ্যাসাঞ্জকেও যে বিতর্কিত করেছে, সন্দেহ নেই। প্রশ্ন উঠছে মি অ্যাসাঞ্জ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করলে তিনি রাশিয়ার বিভ্ন্নি বিতর্কিত বিষয়গুলোতে এতোবছরেও কিছুই প্রকাশ করলেন না কেন?
অনেক যৌক্তিক প্রশ্নেরই উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু, এটুকু স্পষ্ট যে অ্যাসাঞ্জকে সত্যপ্রকাশের জন্য যদি বিচারের মুখোমুখি করা হয় তাহলে তা সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকি তৈরি করবে। তাঁর আইনজীবিদের মত আমরাও আশাবাদী হতে চাই যে ব্রিটেনের আদালত সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে ভিন্ন আরেকটি দেশের হাতে তুলে দেবে না। জামিন খেলাপের জন্য অপরাধী হলেও সাংবাদিকতার জন্য তিনি অপরাধী হবেন না এটাই প্রত্যাশা। ব্রিটেনের আইনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রত্যর্পণের যৌক্তিকতার বিষয়ে আদালতে শুনানি এবং আপিলের যে সুযোগ রয়েছে তা বেশ দীর্ঘ বলে হয়তো আমাদের অপেক্ষাও হয়তো আরেকটু দীর্ঘায়িত হবে।
(১২্ এপ্রিল, ২০১৯ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত বিশ্লেষণ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...