বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে এবং আরও ভালো করবে
এই বক্তব্যই এখন বহুল আলোচিত বয়ান। এমনকি সরকারের উন্নয়ন পথযাত্রায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টির
অভিযোগে অভিযুক্ত বিশ্বব্যাংকও বলছে যে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে যে
পাঁচটি দেশ বাংলাদেশ তার অন্যতম। বিশ্ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরে এই প্রবৃদ্ধি ৭.৩ শতাংশ
হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হলেও আমাদের অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন এই হার হবে ৮ শতাংশের
ওপর। মোট কথা, উচ্চ প্রবৃদ্ধিতেই দেশের সব সমস্যার সমাধান, এটি সবাইকে বিশ্বাস করানোই
মনে হয় সরকারের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার। অবশ্য, অর্থনীতিবিদদের একাংশ – বিশেষত: বামপন্থীরা
– প্রবৃদ্ধির সুফল যে
সবাই সম অনুপাতে পাচ্ছেন না, বরং বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকেই বড় উদ্বেগের কারণ হিসাবে
দেখছেন। বৈষম্য কমানোর জন্য তাঁরা সরকারের প্রতি সুশাসন এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায়
মনোযোগী হওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন। সুশাসন এবং জবাবদিহিতা আমাদের বিদেশি বন্ধু, তথা উন্নয়ন
সহযোগীদেরও অতিপ্রিয় সুপারিশ।
বাংলাদেশ যখন এই উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি অর্জনে মগ্ন,
তখন এক বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি মানুষের মৃত্যুঝুঁকি যতটা কমায়
তার চেয়ে অনেক বেশি কমায় গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। ব্রিটিশ চিকিৎসা সাময়িকী
ল্যানসেট গত ১৩ মার্চ এই সমীক্ষা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১৭০টি দেশের গণতান্ত্রিক
রুপান্তরের ধারা ও বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে উন্নয়নশীল
দেশগুলোর যেখানে গণতন্ত্র যত দূর্বল অসংক্রামক রোগ এবং সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সেখানে
তত বেশি। ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৬ বছরের তত্ত্ব-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন
যে গণতান্ত্রিক রুপান্তরের দূর্বলতার পটভূমিতে মাথাপ্রতি জিডিপি বাড়া সত্ত্বেও হৃদরোগে
আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমেছে মাত্র ১১ শতাংশ। কিন্তু, একই সময়ে গণতন্ত্র, বিশেষত,
অপেক্ষাকৃত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেসব দেশে হয়েছে, সেসব দেশে হৃদরোগে মৃত্যর ঝুঁকি
কমেছে ২২ শতাংশ। ক্যান্সার এবং যক্ষার ক্ষেত্রেও এধরণের বড় ফারাক দেখা গেছে। অসংক্রামক
রোগ বিশ্ব জুড়েই সবচেয়ে বড় ঘাতকে পরিণত হয়েছে এবং বাংলাদেশ তার ব্যাতিক্রম নয়। বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫৯ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক
ব্যাধির কারণে। আর, হৃদরোগ আছে সবার ওপরে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশান্স এর থমাস
বলিকির নেতৃত্বে সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির চেয়ে গণতন্ত্রের
ভূমিকা দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রটিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যূঝুঁকি কমিয়েছে বলে দেখা যায় তা হচ্ছে
সড়ক দূর্ঘটনা। এসব উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে যেখানে গণতান্ত্রিক জীবন উন্নত সেখানে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি কমেছে ১৮
শতাংশ। আর, যেখানে গণতান্ত্রিক রুপান্তরের বদলে মাথাপ্রতি জিডিপি বৃদ্ধিই প্রাধান্য
পেয়েছে সেখানে এই মৃত্যু হার কমেছে মাত্র ৭ শতাংশ। থমাস বলিকি বলেছেন গবেষণায় স্পষ্ট
ইঙ্গিত মিলছে যে জনস্বাথ্যের সঙ্গে নির্বাচনের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। যেসব দেশে
গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটেছে সেসব দেশে গণতন্ত্রায়নের পর প্রতি দশ বছরে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে
তিন শতাংশ হারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ভোটাধিকার এবং নাগরিক অধিকারের বিকাশের
কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য অনগ্রসর অংশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটেছে। বলিকি
এবং তাঁর গবেষণা দল মনে করেন, বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি সমভাবে কার্যকর।
শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার কিম্বা এইচআইভি-এইডসের
মত সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে অবশ্য এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যোগসূত্র ততটা স্পষ্ট
নয়। আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকা
নিয়েছে। দাতা রাষ্ট্র বা সংস্থাগুলো সরকারগুলোর চরিত্র গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক
তা খুব একটা বিবেচনায় নেয় নি। এমনকি, সামরিক শাসনের মধ্যেও এসব ক্ষেত্রে আর্থিক এবং
কৌশলগত সহায়তা বজায় রেখেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নকর্মীরা রাজনীতির জটিলতা এড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতে
এমনসব কর্মসূচিতে জোর দিয়েছেন (যেমন নারী, প্রতিবন্ধী এবং সমকামী ও উভলিঙ্গের মানুষ)
যার উপকারভোগীরা সরকারের ক্ষমতার প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করে না। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের
ক্ষেত্রে এধরণের কার্যক্রম গ্রহণের আরেকটি কারণ হচ্ছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় সহজেই
কাজ হয়। পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব ততটা সমস্যা তৈরি করে না। অধিকাংশ কর্তৃত্ববাদী
রাষ্ট্রে সামগ্রিক স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা হয় সবচেয়ে খারাপ। কেননা, কোনোধরণের কার্যকর
প্রতিরোধের আশংকা না থাকায় জনগণের কল্যাণের প্রশ্নটি সেখানে উপেক্ষা করা সহজ। এমনকি,
ভিন্নমত পোষণকারী বা বিরোধীপক্ষের সমর্থকদের চিকিৎসাসেবায় বৈষম্যের শিকার হওয়ার দৃষ্টান্তও
তিনি দিয়েছেন।
গবেষকরা বলছেন গত দশকে বিশ্ব জুড়েই গণতন্ত্র (মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার অধিকার এবং সভা-সংগঠনের অধিকারের মত বিষয়গুলো) দূর্বল হতে শুরু করেছে। এর ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার
এক-তৃতীয়াংশ – প্রায় আড়াইশো কোটি মানুষ নিজ নিজ দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধন দেখছেন। নিম্ন এবং
মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গণতন্ত্র থাকা না থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনমানে কীধরণের প্রভাব
পড়ে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ কম। ল্যানসেটের এই নিবন্ধে উদ্ধৃত চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের
উন্নয়নযাত্রার চেহারার অদ্ভূতরকমের মিলে তাই কি বিস্মিত হওয়া চলে?
স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন খাতে সরকারঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর
দাপটের কথা আমরা সবাই জানি। আপাতদৃশ্যে চিকিৎসাক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই
বড়ধরণের সেবা সম্প্রসারণ ঘটেছে। কিন্তু, সেবার গুণগত মান সন্তোষজনক তো নয়ই বরং ভোগান্তি
আর হয়রানির অভিযোগই বেশি। সাধ্যে কুলালে তাই সবারই চেষ্টা থাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী
হওয়ার। এক্ষেত্রে, সামগ্রিকভাবে একটা গ্রহণযোগ্য
মান তৈরি এবং তা তদারকির ব্যবস্থা কার্যত অনুপস্থিত। চিকিৎসাক্ষেত্রে সুশাসন দাবি করার
মত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সংসদ এবং সংসদের বাইরেও নেই।
পরিবহন খাতের পরিস্থিতি এর চেয়ে কম নৈরাজ্যকর নয়।
স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) কথাগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি
হারিয়ে যাওয়ায় সড়ক এবং নৌপথে শৃঙ্খলা ফেরানোর দায়িত্ব পান বাস এবং লঞ্চের মালিক মন্ত্রী-সাংসদরা।
সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানগুলো নাগরিকদের জন্য কষ্টের এবং হতাশার । কিন্তু,
অতিমুনাফার লোভে অন্ধ পরিবহন মালিকদের স্বার্থের কাছে এগুলো মূল্যহীন। যেকারণে সড়কে
শৃঙ্খলা আনা এবং দূর্ঘটনা কমাতে আইন ও প্রযুক্তিগত সংস্কার বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
রাজধানীর নাগরিকদের শ্রেণীগত অবস্থান এবং দূর্ঘটনার জনপ্রতিক্রিয়ার মাত্রার ওপর ভিত্তি
করে ক্ষতিগ্রস্ত পিতা-মাতা বা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক অনুদান প্রদানই এখন এই সমস্যার
এক অলিখিত সমাধানসূত্রের রুপ নিয়েছে। এর সঙ্গে সর্বসম্প্রতি যোগ হয়েছে নিহতের স্মরণে
পদচারী সেতু নির্মাণ। তবে, স্মারক পদচারি সেতু নির্মাণে সমাধান খুঁজলে ঢাকার সব রাস্তায়
এরকম সেতুতে যে ঢাকা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
সড়ককে নিরাপদ করতে বিশ্বে পরীক্ষিত বহু পদ্ধতি অনুসৃত
হচ্ছে। সেগুলোর কোনোটিতেই আমাদের আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। তেমনটি হলে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক
সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন করেও তা বছরের পর বছর অচল করে রাখা সম্ভব হতো না। আমরা
উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখবো কিন্তু উন্নত দেশগুলোর যানবাহনের প্রযুক্তি গ্রহণ করবো না। দরোজা বন্ধ না হলে গাড়ি
সচল না হওয়ার প্রযুক্তি তো বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত, যা গাড়িতে সংযুক্ত থাকলে রাস্তায়
যেখানে-সেখানে যাত্রীদের ওঠানামা বন্ধ হতে বাধ্য। উন্নত দেশের যানবাহনে এখন সেন্সর
থাকে তাতে গাড়ি তার নির্দিষ্ট লেনের বাইরে গেলেও সতর্কসংকেত বেজে ওঠে। আমরা কেন সেরকম
কিছুতে সমাধান খুঁজবো না?
গেল মাসের ২৭ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে
আগামী দুবছরের মধ্যে ইউরোপের সব গাড়িতে এমন ডিভাইস যুক্ত করতে হবে যে চলন্ত অবস্থায়
তার গতিসীমা চালক বাড়াতে চাইলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়িটি সেই রাস্তার নির্ধারিত গতিসীমার
মধ্যেই নেমে আসবে।যেসব জায়গায় জনবসতির মধ্যে রাস্তার গতিসীমা ঘন্টায় ৩০ মাইল ছিল সেখানে
গতিসীমা ২০-এ নামিয়ে আনা হচ্ছে। কেননা, এই ১০ মাইল গতি কমালে দূর্ঘটনায় আহত হলেও তা
প্রাণঘাতি হবে না। আমাদের শহরগুলোতে কেন এধরণের গতিসীমা কার্যকর করা যাবে না?
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অনেকেই অবশ্য ক্ষীণকন্ঠে
হলেও স্পষ্ট করে বলতে শুরু করেছেন যে সুশাসন ও জবাবদিহিতা ছাড়া এসব সংস্কার সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী বিরোধীদল ও কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসনের কথা আসলে কতটা
অর্থবহ?
( ৮ এপ্রিল, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ। )
( ৮ এপ্রিল, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন