রাষ্ট্রের ওপর একটি স্বার্থভিত্তিক
গোষ্ঠীর বেআইনী প্রভাব খাটানোর প্রতীকটি প্রায় ২১ বছর পর দখলমুক্ত হয়েছে। রাজধানীর
হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনটিকে এখন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
(রাজউক)। সোজা কথায় আদালতের হস্তক্ষেপে সরকারী জায়গা সরকারের কাছে ফেরত এসেছে।
তবে, জায়গাটির ওপর বেআইনীভাবে নির্মিত ১৬তলা স্থাপনাটি যাঁরা তৈরি করেছিলেন তাঁরা আদালতের
নির্দেশমত ভবনটি সরিয়ে নিতে পারেন নি। এরকম একটি ভবন কারো পক্ষে সরিয়ে নেওয়া
সম্ভবও নয়। এটি অপসারণের একমাত্র পথ হচ্ছে তা ধ্বংস করে তার আবর্জনা সরিয়ে ফেলা,
যার খরচ বিজিএমইএকেই বহন করোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুরো ভবনটি কখন, কীভাবে ভাঙা হবে, তা এখন
রাজউকের মাথাব্যাথা।
১৯৯৮ সালে যখন এই ভবনটির নির্মাণকাজ
শুরু হয় তখন থেকে শুরু করে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এই ভবনটিকে
অবৈধ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পালাক্রমে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা কেউই এই বেআইনী
দখলদারি উচ্ছেদের কোনো উদ্যোগ নেয় নি। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল – আওয়ামী লীগ ও
বিএনপি – উভয় দলেই পোশাক শিল্প মালিকদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকাই যে এর কারণ
তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি, সারা দেশজুড়ে হরে-দরে রাস্তাঘাটের দুপাশ থেকে দখল
উচ্ছেদের জন্য বহুল আলোচিত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও তাদের দৃষ্টি অন্য
দিকে ঘুরিয়ে রেখেছিল। এই অন্যায়ের চিত্র সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হওয়ার পরই আদালত
বিষয়টিতে স্বতপ্রণোদিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার পরিণতিতে এই রায়।
আদালত অপরাধ চিহ্নিত করেছেন এবং
অপরাধের ফসল ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে, অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের সাজা
দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই উদারতা দেখিয়েছেন। যাঁরা এই কাজটি করেছেন, যাঁদের এই
অনিয়মের ওপর নজরদারি ও তা বন্ধের দায়িত্ব ছিল তাদের কারোরই ব্যাক্তিগত দায় চিহ্নিত
হয়নি। গোষ্ঠীগত বিজিএমইকে ভবনটি অপসারণের খরচ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধরে
নেওয়া যায়, এই রায়ে ‘অপরাধকে ঘৃণা কর, অপরাধীকে নয়‘ নীতির নজির
স্থাপিত হয়েছে।
রাজউক বিজিএমইএ‘র কাছ থেকে
ভবনটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ায় সবচেয়ে বড় যে অর্জন তা হলো প্রথমত: রাষ্ট্রীয়
সম্পদের বেআইনী দখলদারিত্বের অবসান। দ্বিতীয়ত: আদালতে আইনবিরুদ্ধ রাজনৈতিক
পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিকার যে সম্ভব তা প্রমাণিত হওয়া। বিজিএমইএ ভবনের বিষয়ে
স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকার কারণে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সাধারণ মানুষের মধ্যে নিঃসন্দেহে
প্রশংসিত হয়ে থাকবে। তৃতীয়ত: নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকার সচেতন নজরদারি এবং
প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীতে
বেআইনীভাবে সরকারী জায়গা দখল, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন কিম্বা ইমারত নির্মাণ
আইন লংঘন করে বিশালাকার স্থাপনা তৈরির একমাত্র নজির এটি
নয়। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যাক্তি পর্যায়ের
দূর্নীতির ফল, গোষ্ঠীগত নয়। বিজিএমইএ‘র নেতৃত্বের
ভূমিকার কারণেই পোশাকশিল্পখাতের এই সমিতির সব সদস্যকে এই অনিয়মের দায়ভার বহন করতে
হচ্ছে।
মাত্র এক দশক আগে বিজিএমইএ ভবনের মতই
এরকম আরও একটি বেআইনী স্থাপনা, র্যাংগস ভবন আদালতের নির্দেশেই অপসারণ করতে
হয়েছিল। তবে, সেই ভবনটি ভাঙ্গার অভিজ্ঞতা ছিল বেদনাদায়ক। ডজনখানেকের বেশি শ্রমিক মর্মান্তিক
মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন। তবে, সেই প্রাণঘাতি দূর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এধরণের বড়
ভবন নিরাপদে অপসারণের সক্ষমতা যে আমরা অর্জন করেছি, তেমন দাবি কেউই করছেন না। পূর্তমন্ত্রী
জানিয়েছেন যে ভবন ভাঙ্গার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে এবং দেশীয় কোনো
প্রতিষ্ঠান না পারলে আর্ন্তজাতিক পরিসরে সহায়তা চাওয়া হবে। তিনি আশাবাদ প্রকাশ
করেছেন যে কাজটি নিরাপদে সম্পন্ন হবে এবং ধ্বংসস্তুপ মাসখানেকের মধ্যেই সরিয়ে ফেলা
সম্ভব হবে।
কাজটি কতটা নিরাপদে করা সম্ভব তার
উত্তর প্রকৌশলীরাই ভালো দিতে পারবেন। রাজউক
চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেছেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরো ভবন ভেঙে ফেলা হবে। গণমাধ্যমের
আলোচনায় জানা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ বা কন্ট্রোলড ডিমোলিশন
পদ্ধতি ব্যবহার করে এটি ধ্বংস করার কথা। এই পদ্ধতিতে আশপাশে কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া
হবে না বলেই তাঁদের বিশ্বাস। প্রকৌশলবিদ্যায় দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং পুরোনো প্রতিষ্ঠান,
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারিও ডেইলি স্টার পত্রিকাকে
জানিয়েছেন যে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ একটি পদ্ধতি হতে পারে। তবে, তিনি জানিয়েছেন এই
প্রযুক্তি, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ পাওয়া বিশেষজ্ঞ কোনোটাই আমাদের নেই।
অতিমাত্রায় জনঘনত্বের কারণে এই পদ্ধতি
প্রয়োগে কারওয়ানবাজার, মগবাজার, ইস্কাটন ও হাতিরপুলের মত এলাকার বসতিগুলোতে
কোনোধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি যে তৈরি হবে না, সেকথা কি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলতে
পারবেন। এতো বড় ভবনের ধ্বংসসাধনের প্রয়োজনে সেখানে যে নিরাপত্তাবলয় প্রয়োজন হবে
তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা সেখানে কোথায়? নাকি, আশপাশের বাসিন্দাদের সাময়িকসময়ের
জন্য অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হবে ? এই কর্মযজ্ঞে যে বিপুল পরিমাণে ধূলা তৈরি হবে
তাতে এসব এলাকার বাতাস শ্বাস নেওয়ার মত নিরাপদ থাকবে কিনা সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। শিশু,
বয়স্ক এবং অসুস্থদের জন্য যে বাড়তি ঝুঁকির আশংকা কি নাকচ করে দেওয়া যায় ?
নাগরিক সমাজের অনেকেই এখন বলছেন যে
ভবনটিকে জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে ব্যবহার করা হোক। এই বক্তব্য একেবারে অযৌক্তিক নয়।
বেআইনী দখলের অবসান ঘটেছে, সরকারের জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে। এখন
তাকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ আছে কিনা তা ভেবে দেখার সুযোগ কি
একেবারেই নেই? ভবনের নীচ দিয়ে অবাধে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করে ভবনটিকে টিকিয়ে
রাখার প্রকৌশলগত সমাধান সম্ভব কিনা সেবিষয়ে সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত যাচাই করে
দেখতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা সমাধান দিতে পারলে আদালতের কাছে সরকার তা তুলে ধরে এটি
অপসারণের ব্যয় ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির বিপরীতে তার কল্যাণমূলক ব্যবহারের প্রস্তাব
বিবেচনার অনুরোধ জানাতে পারে।
স্পেক্ট্রাম ও তাজরিন গার্মেন্টসের
অগ্নিকান্ড এবং রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনাগুলো তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তাঝুঁকির
মর্মান্তিক স্মারক হয়ে আছে। এই খাতের শ্রমিকদের মজুরি এবং অধিকার বিষয়ে বর্হিবিশ্বে
বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই পটভূমিতে পোশাক খাতের
শ্রমিকদের জন্য ভবনটিতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মত প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে
বিবেচনার দাবি রাখে। ভবনটি ভাঙ্গার জন্য যে খরচ বিজিএমইএ‘র বহন করার কথা সেই অর্থও হাসপাতাল
প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানো যায়। এধরণের শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্পে আদালত বর্ণিত ‘হাতিরঝিলের ক্যান্সার‘- এর নিরাময় সবার জন্য সহনীয় হতে পারে। ভবনের ওপরের দুটি তলায় বিলাসবহুল
‘অ্যাপারেল ক্লাবের জন্য নির্মিত সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, রেস্তোরাঁ , সভাকক্ষ ও
মিলনায়তনের এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যবহার আর কী হতে পারে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন