প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয়বারের মেয়াদের প্রথম ১০০ দিন পূর্ণ হচ্ছে আজ। আওয়ামী লীগের ২০১৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রথম ১০০ দিন বা প্রথম বছরের লক্ষ্য হিসেবে আলাদা কিছু চিহ্নিত ছিল, বিষয়টা এমন নয়। এর আগের দুটি নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৪ ও ২০০৮–এর ইশতেহারেও ১০০ দিনের কর্মসূচি ছিল না। তবে সকালের চেহারা দেখে যেমন বাকি দিনটা কেমন যাবে—এমন ধারণা করায় আমরা অভ্যস্ত, তেমনি শতদিনের কার্যক্রমের আলোচনা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়।
প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচি এবং তার মূল্যায়নের ধারণাটি বিশ্বে অবশ্য নতুন কিছু নয়। অনেক দেশেই রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের সরকারের দিশা এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এই শুরুর দিনগুলোকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। তবে এর সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই সরকারের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশ নীতিবিষয়ক প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। এগুলোর জন্য ওই সময়টুকুর মধ্যেই তিনি ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেন। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে বিদেশি সরকারপ্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কাজটিও সেরে ফেলতে সক্ষম হন।
আর্থার এম শ্লেসিঙ্গার জুনিয়রের বই দ্য এজ অব রুজভেল্ট: দ্য কামিং অব দ্য নিউ ডিল থেকে এই তথ্যগুলো উদ্ধৃত করে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের শুরুতেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যাভিমুখ ঠিক করে নিতে উৎসাহিত করে থাকে।
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই অবশ্য এ রকম অনুশীলনে অভ্যস্ত নয়। অধিকাংশ দেশেই সরকারগুলো তার মেয়াদের শুরুর দিকে মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন একটু বেশি পেয়েই থাকে। তবে বাংলাদেশ সব সময়েই ব্যতিক্রম। বিশেষ করে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম দেড় দশকে নির্বাচিত সরকারগুলোর সেই সুযোগ হয়নি। ’৯১ সাল থেকেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে যে দল যখন হেরেছে, সেই দল তখন প্রতিবাদ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। আর ’৯১–তে বাড়তি অস্থিরতার কারণ ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার বদলে সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর আন্দোলন। সেদিক থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের ভাগ্য যথেষ্ট সুপ্রসন্ন ছিল। কেননা, সেবার নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ একেবারেই হালে পানি পায়নি। আর ২০১৪–এর ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন ঘিরে প্রায় তিন মাস ধরে বিরোধীদের সহিংস আন্দোলনের সৃষ্ট ক্ষতের কারণে তখন সরকারের চ্যালেঞ্জটা ছিল একেবারেই আলাদা। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শক্ত দমন নীতি এবং বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক কূটনীতির সফল প্রয়োগে সরকার সেই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। প্রতিবেশী ভারত ও চীন-রাশিয়ার উদার সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে সরকারের বড় সহায় হিসেবে কাজ করেছে।
বলা চলে, তৃতীয় মেয়াদেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে। নির্বাচনের বিষয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় এই তিন বৃহৎ শক্তি সরকারের সঙ্গে থাকায় তার অস্বস্তিবোধ এবার অনেকটাই কম। উপরন্তু, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর আশ্রয়দাতা দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি বিবেচনার বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরুদ্ধ মত প্রায় দমবন্ধ অবস্থার শিকার হওয়ায় একধরনের স্থিতিশীলতা যাঁরা আশা করেছিলেন, সেটা অবশ্য ঘটেনি। এই ১০০ দিনের ঘটনাক্রম স্বস্তিদায়ক নয়, বরং এতে সুপ্ত সংকটের আলামত কিছুটা দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে যে সংকটটি সবার ওপরে প্রকট হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে ভোটাধিকার এবং নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা। এমনকি মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একটি অংশ প্রকাশ্যেই জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচনগুলো থেকে মানুষ এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যে নির্বাচন কমিশন এখন স্বীকার করছে, রাতের বেলা ভৌতিক ভোটে বাক্স ভর্তি হওয়াটাই অন্যতম সমস্যা। আর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে এসব নির্বাচনকে নির্দলীয় রূপে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা এখন সরকারি মহলে আলোচনায় এসেছে। সাংসদদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায় নির্দলীয় নির্বাচনকেও যে কলুষিত করবে না, তার কোনো গ্যারান্টি পাওয়া গেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।
এই ১০০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই দেশের বৃহত্তম ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ২৮ বছর পর সরকার এই নির্বাচন করতে দিয়ে যেটুকু কৃতিত্ব দাবি করতে পারত, তা অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ির কারণে নস্যাৎ হয়ে গেছে। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত করার দায় কিছুটা হলেও সরকারের ঘাড়ে চেপেছে।
সরকারের সাড়ে তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণদের নতুন করে রাজপথে নেমে আসার ঘটনা গত বছরের রাষ্ট্রসংস্কারের আন্দোলনের কথাই সবাইকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সরকার রাজধানীতে পরীক্ষামূলক সার্কুলার রুটের বাস চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা ইতিবাচক হলেও এ ধরনের বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো পদক্ষেপ সামগ্রিক সমস্যার সমাধান দেবে না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কিত মালিক-শ্রমিকদের শক্তিশালী যে গোষ্ঠীগুলোর দুর্বৃত্তপনায় পরিবহন খাত বিপর্যস্ত, তা দমনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও ছাঁটাই বন্ধের আন্দোলনের যে তীব্রতা বছরের শুরুতেই দেখা গেছে, সেই সমস্যারও যৌক্তিক ও মানবিক সমাধান দেখা যায়নি। দেশের ভেতরে অজানা ভয়ের কারণে একধরনের নীরবতা পালিত হলেও বিদেশে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর বিতর্ক চলছে। ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারে তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের জোরালো প্রতিনিধিত্বের কারণে বিষয়টিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে এতে করে সুপ্ত অসন্তোষ বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে হয় না। বাণিজ্য বৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে ঠিকই। কিন্তু, এই উন্নয়ন মন্ত্রে বৈষম্যবৃদ্ধির ধারা যেমন কমবে না, তেমনি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে না। অথচ সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। প্রাথমিক স্কুলের ছাদ ধসে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীর মৃত্যু হচ্ছে এই বৈষম্যমূলক উন্নয়নের নিষ্ঠুর স্মারক।
সম্প্রতি ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের মর্মান্তিক নিপীড়ন ও মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশকে আলোড়িত করেছে। নুসরাতের প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ী মাদ্রাসার অধ্যক্ষের প্রতি মানুষ যতটা ক্ষুব্ধ, ঠিক ততটাই ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রতি, যাঁরা অপরাধীর আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। একই ধরনের ক্ষোভ স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতি। ফেনীর এই চিত্র বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। দেশের অন্য অনেক জায়গা থেকেই একই ধরনের অপরাধ ও দুর্বৃত্তায়নের খবর পাওয়া যায়। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চার সন্তানের জননী ভোটের কারণে ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায়ও এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও প্রশাসনিক প্রশ্রয় ছিল। এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধের জন্য যে সুশাসন প্রয়োজন, তা বর্তমান কাঠামোয় পাওয়া বেশ কঠিন। সমালোচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার পর তাদের সংযত করার ব্যবস্থা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সুশাসনের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। তিনি খোলাখুলিই বলেছেন, ব্যাংক পরিচালকেরা তাঁদের কথা রাখেননি। খেলাপি ও মন্দ ঋণের বোঝা কমাতে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতার কাছে নতুন অর্থমন্ত্রী কার্যত আত্মসমর্পণ করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের পর অতীতে সব সময়ই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ ও আস্থার প্রতিফলন দেখা গেলেও এবারে ঘটেছে উল্টোটা। শেয়ারবাজারের এই অব্যাহত অধঃপতনের কারণও সুশাসনের অভাব—নিয়ন্ত্রক ও নজরদারি সংস্থার ব্যর্থতা।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সুশাসনের নীতি অনুসরণে নজর দিতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নতুন মেয়াদে সরকার গঠনের পর গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সরকারি সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ’ করবেন। শক্তিশালী বিরোধী দল ও কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসনের কথা আসলে কতটা অর্থবহ—এই প্রশ্নই এখন সবার কাছে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। শুরুতে পুরোনো ও অভিজ্ঞ ৩৬ জনকে বাদ দিয়ে নতুন ৩১ জনের অন্তর্ভুক্তিতে মন্ত্রিসভায় চমক সৃষ্টির একটা চেষ্টা যে ছিল, তা অনস্বীকার্য। আরও লক্ষণীয় ছিল মহাজোটের ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে মূলত আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে। অনুগত বিরোধী দল নিয়ে সংসদকে কার্যকর করার পরীক্ষা দ্বিতীয়বার সফল হবে, এমন ধারণা অমূলক।
ক্ষমতাসীন দল যাদের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে, সেই বিরোধী দল বিএনপির হাতে গোনা আধা ডজন সাংসদকে যেকোনোভাবে সংসদে নিয়ে যেতে পারলেই শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব পূরণ হবে, এমন ধারণা অমূলক। এই সংকট কাটাতে হলে বিরোধী মতকে আস্থায় নিতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার এবং অতীত নির্বাচনের অভিযোগ নিষ্পত্তি ছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার জাতীয় ঐক্য ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা আদৌ কি সম্ভব?
(১৬ এপ্রিল, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের বিশ্লেষণ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন