নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকা, দৈনিক বিজয়ের একজন সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর রোববার রাতে বন্দর থানায় তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীদের একজনকে স্থানীয় লোকজন হাতেনাতে ধরে পুলিশের কাছে দিয়েছে এবং পুলিশ পরে আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অবৈধ গ্যাসের সংযোগ এবং মাদকব্যবসার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহের কথা বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে। অবৈধ গ্যাস-সংযোগের দূর্নীতি জনজীবনের জন্য যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জেই গতমাসের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা। ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩৪।
সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকি কতটা, ইলিয়াস হোসেন জীবন
দিয়ে তা আবারও সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। তাঁর এই মৃত্যুতে আরও দুটো বিষয় স্পষ্ট
হয়েছে – প্রথমত:
সাংবাদিকরা শুধু যে সরকার বা ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের বৈরিতার শিকার হন, তা নয়।
অন্যান্য অপরাধীরাও সাংবাদিকদের শত্রুতুল্য গণ্য করে। দ্বিতীয়ত: রাজধানীর বাইরে
মফস্বলের সাংবাদিকদের ঝুঁকি কোনো অংশেই কম নয়। সন্দেহভাজন অপরাধীদের কয়েকজন
গ্রেপ্তার হওয়ায় ইলিয়াস হোসেনের হত্যাকারীদের বিচার দ্রুতই সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। তবে, বাংলাদেশে
সাংবাদিক হত্যা ও তাদের ওপর হামলার বিচারের যে রেকর্ড তাতে আশাবাদী হতে পারিনা।
চলমান মহামারিতেও প্রমাণিত হয়েছে ঢাকার বাইরে দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়িয়ে থাকা সাংবাদিকরা কতটা গুরুদায়িত্ব পালন করেন এবং তা করতে
গিয়ে কোন মাত্রায় ঝুঁকি নেন। মহামারির প্রথম মাসগুলোতে দেশের নানাপ্রান্তে নারী,
শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ লোকজনকে সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য কীধরণের দূর্ভোগ পোহাতে
হয়েছে তার মর্মস্পর্শী ছবিগুলো তাঁদের কল্যাণেই আমরা দেখতে পেয়েছি। করোনাভাইরাস
শনাক্তকরণের জন্য সরকার নির্ধারিত সীমিতসংখ্যক পরীক্ষাকেন্দ্রে অসুস্থ মানুষের
সীমাহীন ভোগান্তি, কিম্বা পোশাককারখানার মালিকদের খামখেয়ালির শিকার হাজার হাজার
শ্রমিকের শত মাইল পায়ে হাঁটার কষ্ট তাঁরাই পাঠক-দর্শকদের কাছে তুলে ধরেছেন। সরকারি
ত্রাণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নয়-ছয়ের কারবার তাঁদের দু:সাহসী
পেশাদারিত্ব ছাড়া কোনোভাবেই আমরা জানতে পেতাম না।
ত্রাণ আত্মসাতের খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে মারধর
খেয়েছেন কতজন তার কোনো হিসাব সরকার তো রাখেই না, এমনকি সাংবাদিক ইউনিয়নের কাছেও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান মিলবে না। শুধু কী মারধোর? এরপর আছে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার। ত্রাণচুরির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাক্তির
চেয়ে তাঁর চেলাচামুন্ডাদের কাছে ‘ওস্তাদের মর্যাদা‘ এতো্টাই গুরুত্বর্পূণ যে তাঁরা একের
পর এক মামলা করার প্রতিযোগিতায় নেমে যান। আর, সরকারি দলের পরিচিতির কারণে
মামলামাত্রই পুলিশ লক্ষ্যণীয়ভাবে তৎপর হয়ে ওঠে, শুরু হয় প্রেপ্তার এবং রিমান্ডের পালা।
অভিযুক্ত ত্রাণচোর চুরির জামিনযোগ্য মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু ডিজিটাল
আইনের কঠিন বিধানে সাংবাদিকের জামিন জোটেনি, দীর্ঘায়িত হয়েছে কারাবাস।
সাংবাদিকদের সুরক্ষার বিষয়ে কাজ করছে যে বৈশ্বিক
সংগঠন, সেই কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, সিপিজের গত ২৩ জুলাইয়ের হিসাব বলছে মার্চের
১০ তারিখ থেকে মের ২১ – অর্থাৎ করোনা
সংক্রমণের প্রথম ৭০ দিনে অন্তত ২২ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা এবং হামলা হয়েছে।
এই ২২ জনের মধ্যে মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং বিডিনিউজ ২৪ এর প্রধান
সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠই ঢাকার বাইরে কাজ করেন। এঁদের কতজন
গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন, আর কতজন জামিন পেয়েছেন, তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য মেলে
না। ডিজিটাল আইনের নির্বিচার প্রয়োগ এখনও অব্যাহত আছে। এর সর্বসাম্প্রতিক শিকার একজন
সাংবাদিক শুধুমাত্র একটি কমা চিহ্ন ভুল জায়গায় বসানোর কারণে আটক হয়েছেন। ভুল বুঝতে
পেরে ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসটি আধঘন্টার মধ্যে মুছে ফেললেও আইনের দীর্ঘ-প্রসারিত হাত
তাঁকে ধরে ফেলেছে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমআরডিআই গত মাসে
ঢাকার বাইরের সংবাদকর্মীদের নিয়ে ‘সাংবাদিকের করোনাকাল: মাঠের অভিজ্ঞতা‘
শিরোনামে এক আলোচনার আয়োজন করেছিল, যেখানে তাঁদের ঝুঁকির মাত্রা এবং তা
মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তার কথাগুলো উঠে এসেছিলো। আয়োজকদের সূত্রে জেনেছি মাঠের সংবাদকর্মীদের ওপর
বার্তাকক্ষের চাপ আর তাদের নিরাপত্তায় প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় ঘাটতির করুণ অভিজ্ঞতার
কথা। হাতে গোণা দু-তিনটি সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যম ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব
সংবাদকর্মীরা না পেয়েছেন ব্যাক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী, না পেয়েছেন বিশেষ ঝুঁকিভাতা।
করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের প্রধান ভরসা ছিল পরিবার ও সামাজিক সহায়তা। করোনায়
আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন সংবাদকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। ঢাকা এবং সারাদেশ
মিলিয়ে এই সংখ্যা অন্তত ৩২ জন, যাঁদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছিল ২১ জনের, আর উপসর্গ
ছিল ১১জনের। মোট আক্রান্তের সংখ্যা
প্রায় হাজারখানেক।
সোশ্যাল মিডিয়ার নাটকীয় বিস্তৃতির কারণে গণমাধ্যম – বিশেষত সংবাদপত্র শিল্প এখন এক অভূতর্পূব
সংকটের মুখোমুখি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু যে মূল খবরটুকুই মিলছে, তা নয়। সঙ্গে সঙ্গে
মিলছে, প্রতিক্রিয়া। আর বিস্তারিত বিবরণ, পটভূমি ও বিশ্লেষণ যেগুলো খবরের কাগজে
ছাপা হচ্ছে, তা-ও অচেনা সামাজিক বন্ধুদের কেউ না কেউ শেয়ার করছেন। ফলে, খবরের কাগজ
না কিনেই কাগজের সবচেয়ে আলোচিত বা গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ
মোকাবিলায় পত্রিকাগুলোর লড়াইটা খুবই কঠিন। একদিকে সংবাদপত্রের আয় কমছে, অন্যদিকে সঠিক
খবরটা তুলে আনার দায় ও খরচ বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যত তথ্য আদান-প্রদান হয়,
সেগুলোর মধ্যেও বিশ্বাসযোগ্যতায় এগিয়ে আছে সংবাদপত্রের খবর। খবরের সত্যাসত্য,
গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা বিচারে সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব কতটা জরুরি, তা সংকট বা
দূর্যোগের কালে আরও বেশি বোঝা যাচ্ছে।
ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের অনেকেই অবশ্য এই পেশায়
খন্ডকালীন, অনেকেই বিনা পারিশ্রমিকে নেশার বশে কাজ করেন। এঁদের দু-চারজনের
বিরুদ্ধে যে অনিয়ম-অসততার অভিযোগ ওঠেনা, তা নয়। তবে, অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতায় নিবেদিত অধিকাংশেরই পেশার প্রতি নিষ্ঠা ও
আনুগত্য সন্দেহাতীত। কিন্তু, তাঁদের শরীরি-অশরীরি উভয়ধরণের ঝুঁকি দুটোই বেড়ে
চলেছে। ক্ষমতাধর রাজনীতিক, প্রশাসন, দুর্বৃত্ত সবার আক্রমণের লক্ষ্য সাংবাদিক। কখনো
কখনো এঁরা সবাই একজোট হয়ে সাংবাদিকদের শিক্ষা দিতে চান। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম
কাজলের চলমান ভোগান্তির সম্ভাব্য কারণ এটাই। গত ১ অক্টৈাবর সিপিজে প্রধানমন্ত্রীর
কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে বারবার তাঁর জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যানের কথা জানিয়ে
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা না করার ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
১৩ অক্টোবরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেল যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, দেশ ও বিদেশ হতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার, জনপ্রতিনিধি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে অসত্য, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে “। এতে আরও বলা হয়েছে, “নিরাপত্তা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্ অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করছে। এতে করে দেশের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা, জনমনে উদ্বেগ, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।” অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ শান্তি নষ্ট করতে পারে, জনমনে উদ্বেগ, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এই আশংকা সঠিক এবং বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ। কিন্তু, কোন সংবাদ অসত্য কিম্বা ভিত্তিহীন তা কী করে বোঝা যাবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। জনপ্রতিনিধি সাংসদ মুজিবর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরীর ফাঁস হওয়া টেলিকথন, নাকি সিলেটে পুলিশের টাকা দাবি করে হতভাগ্য তরুণ রায়হানকে পিটিয়ে মারার ঘটনা? এসব ঘটনা তো প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়াতেই ফাঁস হয়েছে এবং সংবাদপত্র তার সত্যাসত্য যাচাই করেই প্রকাশ করেছে। সাংসদ তাঁর মতো ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু টেলিফোনের কথা অস্বীকার করেননি, পুলিশও গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যুর গল্প থেকে সরে এসেছে।
এসব ঘটনাতেই স্বাধীন সাংবাদিকতার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং, সরকারের উচিত হবে কোনোধরণের লুকোচুরির আশ্রয় না নিয়ে কোন তথ্য ভুল, কোনটি
ঠিক তা স্পষ্ট করে বলা। যে আইন সাংবাদিকদের গণহারে হয়রানির কারণ হচ্ছে, সেই
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অগণতান্ত্রিক ও নিবর্তনমূলক ধারাগুলো পর্যালোচনার
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাতিল করা এবং সাংবাদিকদের ওপর সবধরণের হামলার সুষ্ঠু,
স্বচ্ছ্ব ও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কার্যকর বিরোধীদলহীন বাস্তবতায়
সংবাদপত্রকে সত্য বলা ও সমালোচনার অধিকার না দিলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য।
(১৫ অক্টোবর, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন