বিশ্ব জুড়ে ২৫ বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন
এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত সম্ভাব্য
সহিংসতার আলামতগুলো কী কী? তাঁরা যেসব আলামতের কথা বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে:
-
যে নির্বাচনে লাভ-ক্ষতির মাত্রাটা অনেক
বেশি, উভয়পক্ষই যেখানে তাদের সাফল্যকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই বলে মনে করে কিম্বা তুলে
ধরে;
-
ভোটাররা যেখানে দুই মেরুতে বিভাজিত;
-
বিদ্বেষমূলক বা ঘৃণাবাচক বক্তব্য ও ভুল
তথ্যের ছড়াছড়ি দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এর মধ্যে অর্ন্তভুক্ত;
-
আগে থেকেই বিদ্যমান জাতি বা সম্প্রদায়গত কিম্বা বর্ণবাদী
উত্তেজনা;
উভয়পক্ষই যখন বিশ্বাস করে প্রতিপক্ষ জালিয়াতি না করলে
তারাই জিতবে;
-
নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর
প্রতি একটি বা উভয়পক্ষের অবিশ্বাস;
-
তথ্যসূত্রগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, যেখানে
একপক্ষ অন্যপক্ষের সূত্রগুলোর সত্যবাদিতা নাকচ করে দেয়;
-
খুব সামান্য ব্যবধানে জয় নির্ধারণের সম্ভাবনা;
-
অস্ত্রের ছড়াছড়ি;
-
রাষ্ট্রীয়বাহিনী নয়, কিন্তু সশস্ত্র মিলিশিয়ার
উপস্থিতি;
-
বিভাজন কমানোর বদলে উসকে দেয় এমন রাজনৈতিক
নেতৃত্ব; এবং
-
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আইনী বিবাদের সম্ভাবনা।
নির্বাচনী ঝুঁকির এসব উপাদানগুলোকে
সাধারণভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর লক্ষণ হিসাবেই মনে করা হয়। সদ্য অনুষ্ঠিত
তাঞ্জানিয়ার নির্বাচন কিম্বা মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনের ঝুঁকি নির্ধারণের জন্যই
এধরণের বিশ্লেষণ প্রত্যাশিত। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজে) গত ২৫ বছর ধরে
এই কাজটিই করে আসছে। বসনিয়া, রোয়ান্ডা এবং সোমালিয়ার যুদ্ধ-সংঘাতের পটভূমিতে বিশ্ব
জুড়ে সংঘাত প্রতিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল
ক্রাইসিস গ্রুপ যাত্রা শুরু করে।
কিন্তু, যে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমন
অস্বস্তিকর লক্ষণের কথা কেউ চিন্তাতেও আনবেন না, সেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আইসিজে
এবার এসব লক্ষণের কথা বলছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট রবার্ট
ম্যালির ভাষায় বর্তমান মুহুর্তে আমেরিকায় এগুলোর সবই কোন না কোন মাত্রা্য় বিদ্যমান।
২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম আইসিজে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ঝুঁকিগুলোর দিকে নজর
দিয়েছে এবং তার ব্যাখ্যায় গত ২ অক্টোবর গ্রুপের প্রেসিডেন্ট আইসিজের বিশেষজ্ঞদের
উল্লেখ করা লক্ষণগুলো তুলে ধরেন।
এর ঠিক তিন সপ্তাহ পরে, ২২ অক্টোবর
আইসিজে আবার একটি বিবৃতি দিয়েছে, যেটা আরও গুরুতর। এতে সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে
তাঁরা বলেছেন যে রাজ্যপর্যায় এবং স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের উচিত হবে এটা নিশ্চিত
করা যাতে ভোটপর্বটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। এমনকি, তাঁরা বিদেশী রাষ্ট্রনেতাদের
প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা যেন গণতান্ত্রিক মানদন্ডগুলো মেনে চলার জন্য আহ্বান
জানান। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে আমাদের রাজনীতিক এবং
নাগরিক সমাজের অনেকেই ক্রাইসিস গ্রুপের মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এধরণের মূল্যায়নকে
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনাকাঙ্খিত নাক গলানো হিসাবে অভিহিত করে থাকেন। অবশ্য, তার
চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ হন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।
বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে কিম্বা নাগরিক সমাজের মধ্যে সরকারের সমালোচক হিসাবে
যাঁরা পরিচিত, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময়কে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনকি, এসব বিষয়ে
মন্তব্যের জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের তিরষ্কৃত হওয়ার ঘটনাও আমরা নিকট তীতে দেখেছি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আইসিজের এই বিবৃতিতে তাঁরা হয়তো এখন
কিছুটা সান্তনা খুঁজে পেতে পারেন।
ক্রাইসিস গ্রুপের সর্বসাম্প্রতিক
বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে চলতি বছরের নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি আলাদা করে হিসাবনিকাশের
প্রাথমিক কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে। যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক ইতিহাসে প্রেসিডেন্টের
বিষাক্ত বচনের কোনো নজির নেই – যেগুলোর
মধ্যে আছে নিয়মিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে ঢোকানোর আহ্বান, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের
প্রতি আপাতদৃশ্যে নীরব সমর্থন এবং এমন সব কথা, যাতে মনে হয় সমর্থকদের সশস্ত্র হতে উৎসাহিত
করা হচ্ছে। তবে, সম্ভবত সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে তাঁর দাবি যে জালিয়াতি না হলে
নির্বাচনে তিনিই জিতবেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করতে রাজি
না হওয়ায় নাগরিকসমাজের মধ্যে এর ফলে সহিংস অস্থিরতার আশংকা তৈরি হয়েছে।
এই সহিংসতার আশংকা আসলে আর বায়বীয়
কিছু নয়, বরং গুরুতর বাস্তবতা। নিউইয়র্ক টাইমস কিম্বা ওয়াশিংটন পোস্টের মত পত্রিকাগুলোতে
এই অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্খিত বিপদের বিষয়ে এখন নিয়মিত বিশ্লেষণ ও মতামত ছাপা হচ্ছে। দ্য
ডে আফটার দ্য ইলেকশান ডে শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে হোয়াইট হাউসের বর্তমান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের
অনেকেরই আশংকা যে বিদেশি কোনো শক্তি যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ নিতে পারে।
তাঁরা বলছেন, বিদেশি কোনো সূত্রের বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
অভ্যাসমত ফক্স টিভিতে ফোন করে এমন কিছু বলতে পারেন, যা পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে।
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ভিত্তিতে
বিজয়ী ঘোষণায় অভ্যস্ত টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর এখন চাপ বাড়ছে, ফলাফল স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত
যেন সবাই এধরণের ঘোষণা থেকে বিরত থাকে। আইসিজেও ২৮ অক্টোবর আরও একবার ফলাফল নিশ্চিত
না হওয়া পর্যন্ত কাউকে বিজয়ী হিসাবে তুলে না ধরার জন্য গণমাদ্যম এবং বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের
প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গণনাকৃত ভোটের ফল বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে এধরণের বিজয়ী ঘোষণায়
প্রধান বিবেচ্য থাকে দুই প্রার্থীর মধ্যেকার ভোটের ব্যবধান। কিন্তু, বিভিন্ন রাজ্যে
– বিশেষ
করে যেগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা সেসব জায়গায় ইতোমধ্যে ডাকডোগে মেইল
পাঠানো এবং তা গণনায় অর্ন্তভুক্ত করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রশ্নে যে হারে মামলা
হয়েছে, তাতে আভাষ মিলছে ফলাফল নিয়ে আইনী লড়াই অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত করতে পারে।
তবে, এসব অস্থিরতার ঝুঁকি কাটিয়ে
ওঠার ব্যাপারে আশাবাদও রয়েছে। এই আশাবাদের ভিত্তি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। অরাজনৈতিক
সেনাবাহিনী নির্বাহী ক্ষমতার বেআইনী প্রয়োগ প্রতিরোধে সক্ষম উল্লেখ করে আইসিজে বলছে
অত্যন্ত প্রাণবন্ত সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সংগঠনগুলোও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখার সামর্থ্য রাখে। শান্তির্পূণভাবে
ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে রিপাবলিকান পার্টির জৈষ্ঠ্য নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্যও এক্ষেত্রে
লক্ষণীয়। এছাড়া, ইতোমধ্যেই কোথাও কোথাও রাজ্য পর্যায়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টির
প্রতিদ্বন্দীরা উত্তেজনা প্রশমনে উদ্যোগ নিয়েছেন। ইউটা রাজ্যের দুই গর্ভণরপ্রার্থী
যৌথবিবৃতি দিয়ে এরকম শান্তির্পূণ নির্বাচন ও ফল মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
(১ নভেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন