সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হেফাজতে মৃত্যু আইন ও একজন মায়ের অনশন

সিলেটের যে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে ৩৪ বছর বয়সী তরুণ মো. রায়হান আহমদ নিহত হয়েছেন, সেই বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে তাঁর মা ছালমা বেগম স্বজনদের নিয়ে রোববার আমরণ অনশনে বসেছেন। এই ঘটনার মূল হোতাসহ অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে তাঁর এ অনশন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাঁর হাতের পোস্টারে লেখা আমার ছেলে কবরে, খুনি কেন বাহিরে। রায়হানের মায়ের এই অনশন কর্মসূচির সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার মানুষ ছাড়াও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা একাত্ম হয়েছেন। অভিযোগ হচ্ছে ১০ অক্টোবর রায়হানকে এই ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়, যার পরিণতিতে পরদিন সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পরদিন ১১ অক্টোবর হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে যে মামলা করেন, তাতে প্রধান অভিযুক্ত হলেন ওই ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আকবর হোসেন।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি হয়েছিল আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে, ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর। আইনটির শিরোনাম হচ্ছে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে প্রণীত আইন। আর এ আইন তৈরির কারণ হিসাবে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পূরণ এবং আমাদের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:  হেফাজতে মৃত্যু অর্থ সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু; ইহা ছাড়াও হেফাজতে মৃত্যু বলিতে অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেপ্তারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও নির্দেশ করিবে; কোনো মামলায় সাক্ষী হউক বা না হউক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হইবে। এমনকি, এই আইনের ১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে কৃত কোন অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে এইরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হইবে। হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়ে এই আইনটি বিরোধীদলের সাংসদ থাকাকালে বেসরকারি বিল হিসাবে সংসদে উত্থাপন করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। বেসরকারি বিল সরকারি সমর্থনে পাশ হওয়ার নজির বিরল হলেও এ আইনের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেছিল। বলা চলে, মৌলিক মানবাধিকারের পক্ষে বাংলাদেশের সংসদের এটি একটি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে আইন থাকলেও তার প্রয়োগে সরকার এবং আইনশৃংখলাবাহিনীর অনিচ্ছা একটা বড় বাধা হয়ে রয়েছে। 

হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে পুলিশের কারও প্রথম সাজা হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে প্রায় সাত বছর পর গত মাসে। আইনটি হওয়ার পর ২০১৪ সালে একটি মামলা হয়েছিল। গত ৯ সেপ্টেম্বর এই আইনের প্রথম রায়ে ইশতিয়াক হোসেন নামের এক গাড়িচালককে থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে পল্লবী থানার তৎকালীন পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্য দুই আসামির সাত বছর করে জেল হয়। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু মোটামুটিভাবে নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হলেও পুলিশের হিসাবে গত সাত বছরে হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি।

সিলেটে এসআই আকবরের বিরুদ্ধে এখন অভিযোগের পাহাড় জমছে। এসব অভিযোগ থেকে ধারণা মেলে, আটক-বাণিজ্য নামে নতুন একটি কথা যে বাংলা পরিভাষায় যুক্ত হয়েছে, তিনি তার একটি বড় উদাহরণ। নানা অজুহাতে সন্দেহভাজন হিসাবে আটক ও মুক্তিপণের মত টাকা আদায়ের চেষ্টা এবং তার সঙ্গে নির্যাতন হচ্ছে এই আটক-বাণিজ্যের উপাদান। কক্সবাজারের মেজর সিনহার হত্যাকান্ডের আসামীদের মধ্যে আলোচিত ওসি প্রদীপ এবং এসআই লিয়াকতের বিরুদ্ধেও এখন এই আটক-বাণিজ্যের অসংখ্য অভিযোগ উঠে আসছে।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ছাড়াও গ্রেফতার এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশী হেফাজত বা কথিত রিমান্ডের বিষয়ে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে। উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনা অনুসৃত হলে বিনা পরোয়ানায় বাড়ি থেকে ধরে আনা, কিম্বা পরিচয় না দিয়ে যেকোনো জায়গা থেকে উঠিয়ে আনা, আটক করার পর মামলা দাঁড় করানো, ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করিয়ে অজ্ঞাত জায়গায় আটকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতনের মত কাজগুলো অনেকদিন আগেই বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রয়োজনীয় আইন এবং আদালতের বাড়তি নির্দেশনার পরও পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন কেন কমছে না?

সমস্যাটি কি শুধুই পুলিশের ? নাকি এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র আছে ? যোগসূত্রটি বোঝা যায় গত দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা থেকে। ২০১৩-১৪ তে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণার মুখে পুলিশ যতটা মারমুখী হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকেই এর সূচনা। গত নির্বাচনের প্রাক্কালে আটক-বাণিজ্য কতটা ব্যপক রুপ নিয়েছিল, তা তখনকার সংবাদপত্রগুলোর পাতায় কিছুটা হলেও উঠে এসেছিল। ২০১৮-১৯র ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের সামনের মাঠে জামিনপ্রার্থীদের পরিবারগুলোর উপচে পড়া ভিড়ের সেই ছবিগুলো হয়তো আমরা অনেকেই বিস্মৃত হয়েছি। কিন্তু, আটক-বাণিজ্যের চর্চাটা পুলিশবাহিনীর সদস্যদের অনেকেরই খুব পছন্দের হাতিয়ার হয়ে গেছে। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি ক্যটের পর্যবেক্ষণে গতবছরে এমন কথাই উঠে এসেছে। তাঁরা বলেছেন, হেফাজতে নির্যাতনের প্রধান কারণ সাধারণভাবে দুটো - প্রথমত: জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় এবং দ্বিতীয়ত: আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের কিছু কিছু সদস্যের ঘুষ নেওয়া বা অবৈধপন্থায় উপরি আয়ের ব্যবস্থা। ক্যাটের আলোচনায় দ্বিতীয়টিই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। 

গত ১২ বছরের মধ্যে প্রায় সাত বছরই চলছে কার্যত বিরোধী দলহীন। ফলে, সরকার এবং রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানই এখন জবাবদিহির উর্ধ্বে। এখন রাজনৈতিক আনুগত্যই হচ্ছে একমাত্র বিবেচ্য। পুলিশবাহিনীও এর বাইরে নয়। আইন এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক।

রায়হান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাক্তিদের কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। এমনকি, রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে এবং দুজন কথিত স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তবে, প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর পালিয়ে গেছেন। অভিযোগ উঠেছে, আকবরকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ সহজেই নাকচ করে দেওয়া যায় না। পুলিশ বাহিনীর কারও বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ণের অভিযোগ উঠলে, সতীর্থরা যে তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাবেন, সাহায্য করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশক্ষেত্রেই সেরকমটিই দেখা যায়। ২০১৭ সালে খুলনায় পুলিশী নির্যাতনে দুই চোখ হারানো শাহজালাল তাঁর দৃষ্টান্ত। তিনি বিচার তো পেলেনই না, বরং ভুয়া মামলায় জেল খাটলেন।   

এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে তাহলে রেহাই মিলবে কীভাবে ? জাতিসংঘ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হতে হবে পুলিশমুক্ত স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থায়। নিজেদের অপরাধ নিজেরা বিচার করার রীতি এখন অচল। কেবল তাহলেই নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু আইন ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়ায় অর্থবহভাবে কাজে লাগতে পারে।

(২৭ অক্টোবর, ২০২০র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...