সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ধর্মবিশ্বাস ও বিচারপতি নিয়োগ

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে প্রফেসর এমি কনি ব্যারেটের মনোনয়নে অনুমোদন দেওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছেন এই বিচারপতি আমাদের একটি রাজনৈতিক সম্পদ। বিচারপতি নিয়োগে সিনেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ এবং রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই মনোনয়ন অনুমোদিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনের আগে এতো তড়িঘড়ির পিছনে অবশ্য প্রধান কারণ নির্বাচনে খৃষ্টান ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে যাঁরা গোঁড়া, তাঁদের সমর্থন আদায়। গোঁড়া ক্যাথলিক খৃষ্টান ধর্মবিশ্বাসী এমি কনি ব্যারেটকে তিনবছর আগে ফেডারেল আপিল কোর্টেও বিচারক হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সাত সন্তানের মা ৪৮ বছর বয়সী এমি ব্যারেট গর্ভপাতবিরোধী হিসাবে পরিচিত, যিনি রক্ষণশীলদের কাছে আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হবেন।

ধর্মীয় রক্ষণশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কতটা গুরুত্বর্পূণ তার বেশ কিছু নজির তুলে ধরেছেন পুলিৎজারবিজয়ী সাংবাদিক বব উডওর্য়াড তাঁর সদ্য প্রকাশিত সাড়াজাগানো বই রেজ-এ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ হতে পারে সেদেশের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স (ডিএনআই) এর প্রধান পদে সাবেক সিনেটর ড্যান কোটস এর নিয়োগ পাওয়ার ঘটনাটি।

ড্যান কোটস এর স্ত্রী মার্শা কোটস এর জবানিতে এই বিবরণ পাওয়া যায়। ড্যান কোটস এবং মার্শা উভয়েই ধর্মীয় কারণে ট্রাম্পকে পছন্দ করতেন না। মার্শা ইন্ডিয়ানা রিপাবলিকান পার্টির রাজ্য কমিটির গুরুত্বর্পূণ পদে আসীন থাকায় দলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলোচনায় ভোটের প্রসঙ্গ উঠতে তাঁর এক আত্মীয় বলেন ট্রাম্প তো লোক ভালো না, ভালো খৃষ্টান না, ভালো নৈতিকতার অধিকারী না। মার্শা তাঁদেরকে বলেন তিনিও জানেন ট্রাম্প দু:শ্চরিত্র, নারীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেন। এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, ট্রাম্প গর্ভপাতবিরোধী এবং তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর জন্য অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছেন।

মার্শার কথায় পরিবারের সদস্যদের মন গললো না। কিন্তু, মার্শা তখন বললেন যে আমরা যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে ঐক্যব্দ্ধ না হই, তাহলে আমরা আবারও বামপন্থী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ওয়াশিংটনের দরোজা চারবছরের জন্য খুলে দেবো। রক্ষণশীলরা যে শুধু হোয়াইট হাউজ এবং নির্বাহী সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারাবে, তাই নয়, সুপ্রিম কোর্টও হারাবে। তিনি বলেন রক্ষণশীল, প্রো-লাইফ, ইভানজেলিকাল নারী রিপাবলিকান হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করার সমস্যাটা আমি বুঝি। ট্রাম্প আমার প্রথম পছন্দ নয়, দ্বিতীয় পছন্দও নয়। কিন্তু, আমি বিশ্বাস করি এই পদ তাঁকে বদলে দেবে। ট্রাম্প নির্দেশনার জন্য স্রষ্টার মুখাপেক্ষি হবেন।    

সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় ও তাদের তদারকির দায়িত্ব হচ্ছে ডিরেক্টর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, ডিএনআইর। ট্রাম্প যখন তাঁকে গোয়েন্দা প্রধানের পদ নেওয়ার প্রস্তাব করেন, তখন তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি করান। অতীতে তিনি প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু. তা সত্ত্বেও নির্বাচনে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। এই সমর্থনের অন্যতম প্রধান কারণ সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর আগে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিল গোরশুক এবং ব্রেট কাভানার নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী রক্ষণশীলদের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারপতির মধ্যে রক্ষণশীলের সংখ্যা পাঁচজনে উন্নীত করেন।  

বিচারপতি বাদের গিনসবার্গের মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের প্রাধান্য আরও সুদৃঢ় করার যে সুযোগ এসেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি তাকে কাজে লাগাতে যে তাড়াহুড়ো করলেন, তার কারণও নির্বাচন। মানুষ হিসাবে তিনি নিজে না বদলালেও গোঁড়া ইভানজেলিকাল ভোটারদের কাছে তিনি এখন একজন সংস্কারক। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা যখন তাঁর পুর্ননির্বাচনের সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে, তখন গোঁড়া ধর্মীয় রক্ষণশীলদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার এটাই সবচেয়ে ভালো উপলক্ষ্য।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিচারবিভাগে যে কত বড় রুপান্তর ঘটিয়েছেন, তা যে শুধু সুপ্রিম কোর্টের পরিধিতেই সীমিত, তা নয়। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে মিচ ম্যাককনেল এবং সিনেটের বিচারবিভাগ বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর লিন্ডজি গ্রাহামের সঙ্গে মিলে তিনি তাঁর মেয়াদকালে ফেডারেল আদালতের  প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিচারক নিয়োগ করেছেন, যাঁদের অন্যতম প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে তাঁরা রক্ষণশীল। গত ২২ মে সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আলোচনার সময়েও  বিচারক নিয়োগে তাঁর সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর নিয়োগ করা বিচারকের সংখ্যা ২৮০ ছাড়িয়ে যাবে। তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর দুই মেয়াদে  নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন ১৪২ জন বিচারক। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে ফক্স টেলিভিশনেও মিচ ম্যাককনেল এবং সিনেটর গ্রাহাম বিচারবিভাগের এই পরিবর্তনের কৃতিত্ব বেশ গর্বের সঙ্গে জাহির করেছেন।

এসব বিচারক ফেডারেল আদালতের এবং তাঁদের একটা বড় অংশই আপিল নিষ্পত্তি করে থাকেন। ডেমোক্র্যাটদের আশংকা বিভিন্ন রাজ্যে পোস্টাল ব্যালট কিম্বা ভোটারদের ভোট দেওয়ার পথে বাধা সৃষ্টির ঘটনাগুলোর প্রতিকারের মামলায় এসব বিচারক হয়তো বস্তুনিষ্ঠভাবে আইন প্রয়োগ না করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারেন। আর, সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে এই আশংকা সবচেয়ে বেশি। প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে আল গোরের মামলায় সুপ্রিম কোর্টে হেরে যাওয়ার দু:স্বপ্ন এখনও ডেমোক্র্যাটদের তাড়িয়ে ফেরে। সিনেট জুডিশয়ারি কমিটির শুনাননিতে তাই ডেমোক্র্যাটরা জানতে চেয়েছেন নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ালে বিচারপতি হিসাবে এমি ব্যারেট নিজেকে শুনানি থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন কিনা। প্রশ্নটির কোনো জবাব মেলেনি। ফলে, নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর নিয়োগের পর ডেমোক্র্যাটদের প্রত্যাশা একটাই, তাঁদের প্রার্থী জো বাইডেন যেন এতো বিপুল সংখ্যায় ভোট পান, যাতে কোনো আইনী লড়াইয়ের প্রশ্নই না ওঠে।

(২৭ অক্টোবর ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...