সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে অপরাধের দায়মুক্তি দেয় না

সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের তিনটি জেলায় ধর্ষণের মামলার আসামীর সঙ্গে ধর্ষণের শিকার তরুণীর বিয়ে হয়েছে এবং তা হয়েছে আপাতদৃশ্যে আদালতের সম্মতিতে। অভিযুক্ত ব্যাক্তি অপরাধবোধের মর্মপীড়া সহ্য করতে না পেরে ধর্ষিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর করুণা লাভ করে বিয়ের আদালতের সম্মতি চেয়েছেন, বিষয়টা মোটেও এমন নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আদালতে জামিন চাইতে এসে তাঁরা আদালতকে এধরণের বিয়ের মাধ্যমে আপসরফার কথা জানিয়েছেন। অতঃপর, তাঁরা জামিন চেয়েছেন এবং আদালত বিয়ের পর জামিন মঞ্জুর করেছেন। কারাগারে অথবা আদালত চত্বরে বিয়েগুলো হয়েছে পুলিশের উপস্থিতিতে। 

অভিযুক্তকে সাজা না দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। তবে, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে এটি আদতে সংশোধনের সুযোগ হিসাবে বিবেচ্য হতে পারে কিনা, সেটি একটি অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন। আমরা প্রাজ্ঞ বিচারকদের বিচারিক বিবেচনার সমালোচনা করছি না। কিন্তু, একটি ব্যাতিক্রমই যখন স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নিতে কষ্ট হয়, সেখানে এতো অল্প সময়ে দেশের তিনটি জেলায় তিনটি ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও শংকিত না হয়ে পারা যায় না।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো, বিশ্ব জুড়ে এখন দাম্পত্য জীবনেও সঙ্গী/ সঙ্গিণীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ককেও ধর্ষণের শ্রেণীভুক্ত অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও যৌন লাঞ্চনাকে ধর্ষণের সমতুল্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। এসব অপরাধের শাস্তি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে এবং আপসরফার কোনো সুযোগ রাখা হচ্ছে না। আপসরফার সুযোগ না রাখার প্রধান কারণ হচ্ছে অপরাধীর বা তার পক্ষ থেকে  লাঞ্ছিতাকে আপস করতে বাধ্য করার মতো কোনো হুমকি যেন তৈরি না হয়। 

কয়েকবছর ধরে অভিযোগ উঠছে যে প্রশাসন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। অধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলো এবং নারী আন্দোলনকারীদের মৃদু সমালোচনায় অবশ্য অবস্থার খুব একটা  পরিবর্তন ঘটেনি।প্রশ্ন হচ্ছে এসব অপরাধীরা এখন কিভাবে আদালতের অনুকম্পা ও প্রশ্রয়লাভের সাহস পাচ্ছে? আইনের শাসন ও আইন প্রয়োগে আদালতের বস্তুনিষ্ঠ ন্যয়বিচারে বিশ্বাসী হিসাবে যেসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না, সেগুলো তাই আলোচনায় আনা প্রয়োজন। 

প্রশ্নগুলো হচ্ছে : ধর্ষণ কি তাহলে আর অপরাধ নয়? ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে কি তাহলে এই ঘৃণ্য অপরাধের দায়মুক্তির পথ? ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ের আগে আইনের চোখে আদালতের কাছে যে অপরাধী, বিয়ের কারণে সে নিরাপরাধ হয়ে যাবে? এসব বিয়ের জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকে যে নতুন করে ভয়ভীতি দেখানো হয়নি অথবা তিনি যে হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে এধরণের বিয়ের আপস করতে বাধ্য হননি, তা কীভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে? বিভিন্ন অপরাধের অভিযুক্তরা যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর হন, তাহলে তাঁরা ভুক্তভোগী অভিযুক্তদের কীভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহার অথবা সাক্ষী না দিতে বাধ্য করে থাকেন, তার ভুরি ভুরি নজির আমাদের সবার জানা। আপস হিসাবে বিয়েতে রাজি হওয়া কি ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য অবিচার নয়? ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের কথিত সামাজিক সম্মান রক্ষার যুক্তিতে ওই নারীর ওপর কি দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি গুরুতর অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হলো না? ধর্ষণে যেখানে শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও ধর্ষিতার সম্ভ্রম বা মানবিক মর্যাদাকে আঘাত করা হয়, তা কি এধরণের বিয়েতে পুনরুদ্ধার হবে? ধর্ষণের শিকার নারী যে বিয়ের পর ধর্ষণকারীর দ্বারা আরও বেশি এবং নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? বিয়ের শর্তে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যাক্তি যে পরে বিচ্ছেদ ঘটাবে না কিম্বা ফেরার হবে না, তা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? এর পরিণতি হতে পারে ধর্ষণকারীর পরিবারে অন্যদের দ্বারা সারাক্ষণ নিগৃহীত হওয়ার মত অবিশ্বাস্য যন্ত্রণাদায়ক এক পরিস্থিতি। বিয়ের পর ওই নির্যাতিতা নারী কি তাঁর নতুন স্বামীর সম্পদ ও পারিবারিক সম্পদে ন্যায্য উত্তরাধিকার পাবেন? আদালত কি তা নিশ্চিত করেছেন? 

বিয়ের শর্তে আপসরফার পর আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে এমন অপরাধী আছেন যিনি শুধু ধর্ষণের আসামী নন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিংয়েরও অভিযোগ আছে। একজন প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তাঁদের অন্তরঙ্গ ছবি প্রচারের হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, তাঁর স্বামীর কাছে ছবি পাঠিয়ে তাঁর সংসার ভেঙ্গেছেন, কিন্তু বিয়ে করতে রাজি হননি। শুধুমাত্র মামলা হওয়ার পর এখন জেল এড়ানোই যে তাঁর একমাত্র চিন্তা ও চেষ্টা হবে, তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এধরণের অপরাধী স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন গড়ে তুলবে, এমন অবাস্তব ভাবনার ভিত্তি কী? 

অপরাধীকে সাজা দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদেরকে সম্ভাব্য অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করা। এই যুক্তি দেখিয়েই সম্প্রতি ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের প্রচলন করা হয়েছে (যদিও মৃত্যুদন্ড অপরাধ নিবৃত্তকরণে যে অধিকতর কার্যকর নয, তা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত)। এখন বিয়ের মাধ্যমে যদি দায়মুক্তির সুযোগ মেলে তাহলে তার পরিণতিতে ধর্ষণের প্রকোপ যে বাড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী? আমরা এমন ঘটনার কথাও শুনি যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে শিক্ষা দিতে অনেকে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ করছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর অন্তত একটি মামলা এমনই । বিয়ের মাধ্যমে আপসের সুযোগ আইনের চোখে বৈধতা পেলে তা যে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেই আশংকা আর মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। এধরণের ঘটনা যে কোনো মেয়ের জীবনকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট।

ধর্ষণ হচ্ছে একটি সহিংসতা। এর আগে প্রেম ছিল কি ছিল না, তা একবারেই গৌণ বিষয়। প্রণয়টি পরকীয়া কিনা, তাও বিবেচ্য নয়। ধর্ষণের বিচার নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচার। আইন অনুযায়ী আদালত সহিংসতার বিষয়টিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না, মার্জনাও করতে পারেন না। অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনসম্মত সাজা প্রদান, প্রমাণ না হলে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া এই দুটি ব্যবস্থার বাইরে ভিন্ন কিছু করার যৌক্তিকতা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ধর্ষণের মামলাগুলো প্রধানত শিশু ও নারী নির্যাতন দমনে আইনে হয়ে থাকে। ওই আইনে অপরাধের বিচার প্রশ্নে কোনো আপসরফার সুযোগ আছে বলে আমাদের জানা নেই।

আপসরফায় বিয়ের কারণে যাঁদের জামিন দেওয়া হয়েছে, তাদের অপরাধের বিচার আইন অনুযায়ী না হলে যে নতুন নজির তৈরি হচ্ছে, তার ফলটা সাময়িক না হয়ে সুদূরপ্রসারী হতে পারে। সেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে বিশ্ব জুড়ে যে আন্দোলন এবং উদ্যোগগুলো শেুরু হয়েছে, বাংলাদেশ তার থেকে আলাদা হয়ে ভিন্নপথে চলতে পারে না। সেটা কাম্য নয় এবং সমর্থনযোগ্য নয়। তাই প্রশ্ন ওঠে যে রাষ্ট্রপক্ষ কি এবিষয়ে সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল? বিষয়টিতে আমাদের উচ্চ আদালত দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন, সেই আশা অবশ্য আমরা এখনও হারাইনি। 

(১ ডিসেম্বর, ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...