আমাদের পুলিশ প্রধান, মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, থানায় বসে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হতে পারে না, হবে না। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এই প্রশ্নের পটভূমি হচ্ছে কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় আদালতে দাখিল হওয়া অভিযোগপত্র। অভিযোগপত্রটি পেশ করেছেন র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা, খায়রুল ইসলাম। আদালতের নির্দেশে তদন্তটি করেছে র্যাব এবং প্রায় তিন মাস ধরে তদন্তের পর অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল টেকনাফ থানায় বসে। বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও তাঁদের তিনজন বেসামরিক তথ্যদাতা ওই ষড়যন্ত্রে অংশ নেন।
তদন্তকারী একইসঙ্গে মোট চারটি মামলার তদন্ত করেছেন এবং
পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন প্রমাণিত হওয়ায় আদালতে
অভিযুক্ত সিনহার সতীর্থদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদন
দিয়েছেন। বেআইনী মাদক রাখা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার সাজানো অভিযোগে মামলা হয়েছিল
দুটি থানায় – টেকনাফ ও
রামুতে। সাবেক ওসি এবং পুলিশের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের যে
অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেই মামলাটি
করেছিলেন নিহত মেজর সিনহার বোন। মেজর সিনহার হত্যাকান্ড ঘিরে দায়ের হওয়ার
মামলাগুলোর পরিণতি থেকে অন্তত দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত: থানায় বসেই পুলিশের
সদস্যরা অপরাধের ষড়যন্ত্র করতে পারেন এবং করেছেন। দ্বিতীয়ত: পুলিশ নিজেদের অপরাধ
আড়াল করতে অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করতে পারে। অপরাধের
শিকার ভুক্তভোগীকে উল্টো ফাঁসানোর এই চর্চাটি যে হঠাৎ করে ঘটেনি, বা একেবারে নতুন
নয়, তার প্রমাণ হচ্ছে একটি নয় যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায় মামলা দিয়ে নাকানি-চোবানির ব্যবস্থা
করা। নাহলে তিনটি মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রয়োজন হতো না।
মেজর সিনহার মামলাটি যে একটি ব্যাতিক্রম, তা নতুন করে বলার
কিছু নেই। ব্যাতিক্রমের কারণ হচ্ছে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া, যা বেসামরিক
নাগরিকদের ক্ষেত্রে ঘটার কোনো কারণ নেই। বেসামরিক নাগরিকরা পুলিশের কোনো সদস্যের
অপরাধের বিচার চাইলে আদালতের আদেশ অথবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তা যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে,
এমন নজির বিরল। জনপ্রতিক্রিয়ার চাপে দু-একটি
অভিযোগ পুলিশ যদি বিবেচনায় নেয়ও, তার তদন্ত তারা নিজেরই করে। ফলে, পক্ষপাতদুষ্ট
তদন্তে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা তিরোহিত হয়। রামু থানায় পুলিশের মিথ্যা
মামলা কি প্রমাণ করে না যে অভিযোগের মুখে পুলিশের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ কতটা প্রবল হয়ে
ওঠে; এবং অন্য থানাতেও সাজানো মামলা দয়ের হয়ে যায়?
র্যাবের পক্ষ থেকে মেজর সিনহাকে হত্যার কারণ হিসাবে বলা
হয়েছে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফে বৈধ
অস্ত্র ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের যে অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছিলেন, তা তিনি জেনে
গিয়েছিলেন। এই অবৈধ কর্মকান্ডের কেন্দ্রে আছে বেআইনী মাদক, ইয়াবার ব্যবসা। প্রদীপ
কুমার দাশের অপরাধগুলোর কথা পুলিশের অজানা থাকার কথা নয়। দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রধান
শিরোনাম না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু খবর সময়ে সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। ২৮
ফেব্রুয়ারি ফরাসি টেলিভিশন ফ্রান্স ২৪ও এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তাঁর এই অপকীর্তির
বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছিল। মাদকের কথিত নোংরা যুদ্ধের অংশ হিসাবে ২০১৯ সালে প্রদীপ
কুমার দাশ ‘বন্ধুকযুদ্ধ‘ ঘটিয়ে ১১৭জনকে হত্যা করেছেন বলে সেই
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল। পুলিশ সদর দপ্তর সেই অভিযোগ গায়ে মাখেনি। ফরাসি টিভির
অনুষ্ঠান ছাড়াও তাঁর এধরণের অভিযান এবং প্রকাশ্য জনসমাবেশে সন্দেহভাজনদের নিশ্চিহ্ন
করে দেওয়ার হুমকির আরও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতেও (ইউটিউব এবং ফেসবুকে) প্রচারিত হয়েছে। টেকনাফে এতো বেশি সংখ্যায়
বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে তদন্তের কথা আমি নিজেও তখন ইংরেজিতে লিখেছি ( ক্রসফায়ার ডেথস
ইন টেকনাফ: হোয়াই হ্যাভ দেয়ার বিন সো মেনি, ৭ মার্চ, ২০২০, ডেইলি স্টার)। ‘থানায় বসে হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা হতে পারে না‘ – এই নির্দেশনা কি তখন দেওয়া হয়নি? তাহলে তো
মেজর সিনহার এই পরিণতি হয়না?
পুলিশবাহিনীর সদস্যদের অপরাধের ক্ষেত্রে বেসামরিক
ভুক্তভোগীদের স্বচ্ছ্ব ও সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যয়বিচার পাওয়ার কোনো কার্যকর পদ্ধতি যদি
থাকত, তাহলে ওসি প্রদীপ অনেক আগেই চাকরি হারাতেন এবং বিচারের মুখোমুখি হতেন।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে তাঁর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর কোনোটিরই যথাযথ তদন্ত
হয়নি। বিভাগীয় তদন্তের নামে যা ঘটে, তেমনটিই ঘটেছে। অবশ্য, শুধু প্রদীপ দাশ কেন,
দেশের আরও অনেক জায়গাতেই পুলিশের নানা পর্যায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগের
কথিত বিভাগীয় তদন্তগুলোর পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি। পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদশর্ক,
মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিষয়টির গুরুত্ব মেনে নিয়ে তাই সিনহা হত্যার পর লিখেছিলেন,
অভিযোগগুলোর তদন্ত শুধু স্বচ্ছ্ব ও সুষ্ঠু হলেই হবে না, তা যে সুষ্ঠূভাবে হচ্ছে অন্যরা
যেন সেভাবেই সেটি দেখতে পান। তিনিও লিখেছেন যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পুলিশের
বাইরের কোনো একটি তদারককারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যালোচনার ব্যবস্থা প্রয়োজন (
পুলিশিং দ্য পুলিশ, অগাস্ট ৩০, ২০২০, ডেইলি স্টার)।
নিজেদের অপরাধের তদন্ত ও বিচার নিজেরাই করার নীতি যে অচল
এবং পুলিশসহ সব আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ক্ষেত্রেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন
প্রয়োজন, সেকথা আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। পুলিশের
বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির কারণে বাহিনীটির সদস্যরা
বিচার থেকে রেহাই পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এবং তা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। জাতিসংঘের
নির্যাতনবিরোধী কমিটিও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের এই দায়মুক্তির বিষয়টিকে বিশেষভাবে
গুরুত্বর্পূণ বলে বিবেচনা করে বলেছে, নিজেদের একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার বদলে এই
বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ একই ইউনিটের অফিসার বা তাঁদের উর্ধ্বতন
কর্মকর্তারা তদন্ত করলে সেখানে যে স্বার্থের সংঘাত থাকে তা উদ্বেগের বিষয়।
সেকারণে, কমিটি স্পষ্ট করে বলেছে যে এমন একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা করতে হবে, যাতে
আইনশৃংখলাবাহিনীগুলোর কোনো সদস্য থাকবে না। এছাড়াও কমিটি অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের
সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তাদের সুপারিশমালায় উল্লেখ
করেছে ।
দেশের বিদ্যমান আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তে
পুলিশ ছাড়া অন্য কারও আইনগত ক্ষমতা তেমন একটা নেই। ভুক্তভোগী কেউ যদি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আইনের
আশ্রয় চায়, তাহলে আদালত এরকম ব্যবস্থা নিতে পারে। সিনহা হত্যাকান্ডে র্যাবের
তদন্তও হয়েছে আদালতের নির্দেশে। কিন্তু, র্যাব পুলিশের একটি বিশেষায়িত শাখা হওয়ায়
তাদের প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। র্যাবে সেনাবাহিনীর
অংশগ্রহণের কারণেই সিনহা হত্যা মামলাটি ব্যাতিক্রম। কোনো কোনোক্ষেত্রে পুলিশের
আরেকটি শাখা পিবিআইকেও আদালত তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে বলে দেখা গেছে। কিন্তু,
সেগুলোও যে সুষ্ঠূ হয়েছে, তা বলা যায় না। খুলনায় টাকা দাবি করে চোখ তুলে নেওয়ার
ঘটনার শিকার মোহাম্মদ শাহজালালের বিচার না পাওয়ায় তার নজির মেলে।
এধরণের ঘটনার তদন্ত করার সীমিত এখতিয়ার অবশ্য মানবাধিকার
কমিশনের রয়েছে, যদিও তার মূল্য অনেকটিই প্রতীকি। কিন্তু, পুলিশসহ
আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের তদন্তেই তাঁদের আগ্রহ নেই। কারণটা প্রধানত
রাজনৈতিক। ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্য বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কমিশনের সদস্যদের কাছ
থেকে সেটা আশা করার যে কোনো কারণ নেই, তা গত এক দশকে মোটামুটি প্রমাণ হয়ে গেছে।
আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা এবং দায়মুক্তি
ভোগ করার প্রধান কারণ হিসাবে বলা হয় যে তারা ক্ষমতাসীন
দলের রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলেই এমনটি ঘটেছে। এর বিপরীত বাস্তবতা
হচ্ছে, রাজনৈতিক বিকল্পের অনুপস্থিতি। সরকারের ওপর কার্যকর রাজনৈতিক চাপ
প্রয়োগের মত বিরোধীদল না থাকায় আইনগত সংস্কারের কোনো তাগিদ সরকার উপলব্ধি করছে না।
মেজর সিনহার হত্যাকান্ডের পর সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে দাবি উঠেছিল বিচারবর্হিভূত
হত্যা, গুম এবং নির্যাতনের সংস্কৃতির অবসানের। পুলিশের অপরাধ তদন্তের আলাদা ও স্বাধীন
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও এই নাগরিক সমাজের ঐক্য ও চাপের ওপর নির্ভরশীল।
(১৭ ডিসেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন