বছরের প্রায় শুরু থেকেই চারিদিকে দু:সংবাদ। অধিকাংশই মুঠোফোনে। সংবাদপত্রের অনলাইন, খবরের পোর্টাল, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, সাধারণ বার্তা, টেলিফোন – সব মাধ্যমেই এই দু:সংবাদের ছড়াছড়ি। আধুনিককালের মুঠোফোনের পর্দায় আঙ্গুল ঠেলেই এসব মন খারাপের খবর মেলে, কিন্তু আঙ্গুল ঠেলার অভ্যাস তো কেউ ছাড়ি না। দু:সংবাদের স্রোতে সাঁতার কাটার এই অভ্যাসকে এখন বলা হচ্ছে ডুমস্ক্রলিং বা ডুমসার্ফিং। চলতিবছরেই এই শব্দ দুটির আর্বিভাব এবং বিস্তারলাভ ঘটেছে। অভিধানপ্রণেতারা এখনও তা অভিধানে যোগ করেন নি, তবে মেরিয়াম ওয়েবস্টার বলছে তারা এই শব্দগুলোর ওপর নজর রাখছে। নিউজিল্যান্ড অবশ্য গেল সপ্তাহে এই বিশেষণকেই ২০২০‘র শব্দ ( ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার) ঘোষণা করেছে। আমাদের জন্য, অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের জন্য দু:সংবাদ হচ্ছে এই দূর্ভাগ্যই যেন এখন স্থায়ী হতে চলেছে। সাংবাদিকতার জন্য সম্ভবত ২০২০ হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ বছর।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেসকোর হিসাবে
চলতিবছরে ৫৯ জন গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চারজন নারীও আছেন। বাংলাদেশও
বাদ যায়নি, প্রাণ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। এই হিসাব ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বছরের
বাকি কয়দিনে আর কারো প্রাণহানি না ঘটুক সেটাই কামনা করি। কিন্তু, হিসাবটা গড় করলে প্রতিমাসে
প্রায় পাঁচজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে, ইউনেসকোর ভাষায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য।ওই দিন
ইউনেসকোর এক টুইটে বলা হয়, ‘‘আমাদের সবার জীবনে যা প্রভাব
ফেলে, মানবাধিকার থেকে পরিবেশগত অপরাধ, ক্ষমতার অপব্যবহার উন্মোচন করেন সাংবাদিকরা।
ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য মূল্য দিতে হয়। আমাদেরকে অবশ্যই তাঁদের পক্ষে, তাঁদের
নিরাপত্তার জন্য দাঁড়াতে হবে। সময় #সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার, #দায়মুক্তির ইতি ঘটানোর‘‘।
ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলি জানিয়েছেন যে অন্যান্য বছরের চেয়ে
এবছরে প্রাণহানির সংখ্যা কিছুটা কম হলেও নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে এবং বিশ্ব জুড়েই মতপ্রকাশের
স্বাধীনতার সংকোচন দেখা গেছে। এবছরে মৃত্যুর সংখ্যা আপেক্ষিকভাবে কম হওয়ার ব্যাখ্যায়
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বলেছে করোনা মহামারির কারণে অনেকটা সময় ধরে
বিশ্ব জুড়ে যোগাযোগ বন্ধ থেকেছে এবং সংঘাতর্পূণ এলাকায় সাংবাদিকরা কম যেতে পেরেছেন।
ইউনেসকোর হিসাবে বিশ্বের ৬৫টি দেশে অন্তত ১২৫টি প্রতিবাদ-বিক্ষোভের খবর সংগ্রহের সময়
সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছেন। বছরের প্রথমার্ধে এই সংখ্যা ছিল ২১টি, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে
তা বহুগুণে বেড়েছে।
এমনিতেই গত কয়েকবছর ধরে গণতন্ত্রের যে ক্ষয়সাধন চলছে, তাতে বিশ্বের
নানাপ্রান্তে সাংবাদিকতা ক্রমশই প্রতিকূলতার মুখে পড়ছিল। এখন কোভিড ভাইরাসের মহামারি
সেই চাপ আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলো জনস্বাস্থ্যজনিত
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ আরোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
তথ্য পাওয়া এবং তা প্রকাশ করা কতোটা দুরুহ হয়ে পড়েছে, সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের
ভালোই হয়েছে। মহামারিকালীন সরকারী ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দূর্নীতির খবর সংগ্রহ ও প্রকাশের
জন্য অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নিবর্তণমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে
এবং অনেককেই জেলে যেতে হয়েছে। জুলাই মাসে সম্পাদক পরিষদের হিসাবে মামলার সংখ্যাটি ছিল
৪০ এবং গ্রেপ্তার ৩৭ জন। আর, আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের সংকলিত পরিসংখ্যান বলছে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ২১৯
জন সংবাদকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। হামলা, মামলা ও হয়রানি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে
যে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গুমের শিকার হয়ে ৫৩ দিন অজ্ঞাতবাসের পর ফিরে আসলেও তাঁকে
কারাগারে আটক থাকতে হয়েছে মাসের পর মাস। আদালত ১৪ বার তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান
করেছেন।
সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করে যে রিপোর্টাস স্য ফ্রঁতিয়ে ( আরএসএফ),
তারাও তাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচক প্রকাশের সময়ে বলেছে যে পাঁচটি সংকটের
সম্মিলন ঘটছে এবং একারণে সাংবাদিকতার জন্য আগামী দশক খুবই গুরুত্বর্পূণ। তারা যে পাঁচটি
সংকটের কথা বলেছে, সেগুলো হলো: কর্তৃত্ববাদি
শাসকদের আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণে ভূরাজনৈতিক সংকট; গণতান্ত্রিক নিশ্চয়তার অভাবে প্রযুক্তিগত
সংকট; মেরুকরণ এবং নিবর্তনমূলক নীতির কারণে গণতন্ত্রের সংকট; গণমাধ্যমের প্রতি বিদ্বেষ
এবং সন্দেহ তৈরি কারণে আস্থার সংকট; এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাংবাদিকতায় দারিদ্র।
কর্তৃত্ববাদি শাসকরা কথিত ভুয়া খবর বা ফেক নিউজের ধূয়া তুলে তথ্যপ্রবাহে
তাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ তৈরি ও ধরে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিউইর্য়ক টাইমসের
ওয়াশিংটন ব্যুরোর প্রধান এলিসাবেথ বুমিলার গত ৯ ডিসেম্বর ওর্য়াল্ড প্রেস ফ্রিডম কনফারেন্সে
বলেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গণমাধ্যমকে গণশত্রু অভিহিত করার সময় যে ভুয়া খবর বিশেষণটি
ব্যবহার করেছেন, গত চারবছরে বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারী
কর্তাব্যাক্তিরা তা অনুকরণ করেছেন। এই নিয়ন্ত্রণপ্রবণতা আমাদের দেশেও দিন দিন যে কতটা
প্রকট হচ্ছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
গণতন্ত্রের দূর্গতিও আমরা প্রতিনিয়তই টের পাই। সভা-সমিতির অধিকার
ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন শুধুই সরকারসমর্থকদের। প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমগুলোতেও আইনী-বেআইনী
নিয়ন্ত্রণের নিগড় ক্রমশই কঠিন হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও সম্প্রচার নীতিমালা
ও অনলাইন নীতিমালার মত বিভিন্ন পথে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। বিপরীতে
ক্ষমতাধরদের একতরফা প্রচার, অপপ্রচার, বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমগুলো
ব্যবহৃত হচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও সাংবাদিকতার পাল্টা হিসাবে এগুলো বড়ধরণের হুমকি হয়ে
উঠছে। অনলাইনে গুজব বন্ধের নামে অনেকক্ষেত্রেই হয়রানির শিকার হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম
ও সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকতার ওপর অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরএসএফ
বলছে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতি সংবাদপত্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে দুই ভাবে
– কাগজের বিক্রি
এবং বিজ্ঞাপনের আয় কমেছে, কিন্তু উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থার খরচ বেড়েছে। ফলে, সাংবাদিকরা
চাকরি হারাচ্ছেন। করোনাকালে এই সংকট আরও গভীর হয়েছে। বাংলাদেশে এই সংকটের কারণে মূলধারার
প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাঁটাই ও পত্রিকার আকার কমানো
হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে এবং সাংবাদিক-কর্মীদের বেতন-ভাতা
বাকি পড়েছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিগত সহায়তা দেওয়ার বদলে সরকারিভাবে বাছাই
করে বিপদগ্রস্ত সংবাদকর্মীদের দশ হাজার টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়েছে, যা প্রয়োজনের
তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এরকম অনুদান অবশ্য জাতীয় প্রেসক্লাবকেও দেওয়া হয়েছে, যার অংক
পঞ্চাশ লাখ টাকা। এগুলো সাংবাদিকতার জন্য যতটা না সহায়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর
আনুগত্য নিশ্চিত করায়।
এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে সাংবাদিকতা ‘নিশ্চিহ্ন‘ হয়ে যাওয়ার
আশংকা তৈরি হয়েছে বলে ইউনেসকো তার জার্নালিজম, প্রেস ফ্রিডম অ্যান্ড কোভিড ১৯ প্রতিবেদনে
উল্লেখ করেছে। এই বাস্তবতায় দাবি উঠেছে সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে তদন্তের জন্য
জাতিসংঘের একটি স্থায়ী সংস্থা প্রতিষ্ঠার। তবে, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকদের দাপটে তা
সহসা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে, আশার কথা হচ্ছে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে
হামলার মত অপরাধের দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে জাতিসংঘ একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
দায়মুক্তির ইতি ঘটাতে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সংলাপ, সমস্যাগুলোর বিষয়ে
নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুত তথ্য সংকলন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো এই পরিকল্পনায়
আছে। এছাড়া, আর্ন্তজাতিক পরিসরে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইনজীবিদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের হিউম্যান রাইটস
ইনস্টিটিউট গত ২৬ নভেম্বর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষরের
জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের প্রস্তাবের
মধ্যে আছে এধরণের হামলা দ্রুত তদন্তের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স প্রতিষ্ঠা; সাক্ষ্যপ্রমাণ
সংগ্রহে বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সহায়তা করা ও সেগুলো জাতিসংঘের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায়
স্থানান্তর; এবং সাংবাদিকদের অধিকার হরণের জন্য জবাবদিহি আদায়ে জাতিসংঘ কাঠামোয় সক্ষমতা
গড়ে তোলা।
নিউইর্য়ক টাইমসের এলিসাবেথ বুমিলার অবশ্য আশা জাগানিয়া আরেকটি কথাও
বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের বিষোদগার ও আক্রমণ
সত্ত্বেও তাঁর পত্রিকার পাঠক এবং ডিজিটাল গ্রাহকের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। নিউইর্য়ক
টাইমস তাদের এই সাফল্যের জন্য সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কথাই বলে থাকে। সংবাদপত্র
ও সংবাদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাই টিকে থাকা ও সমৃদ্ধির জন্য ক্ষমতাধরদের জবাবদিহিতা
আদায়ে সাংবাদিকতার যে চ্যালেঞ্জ, তা পূরণেই মনোযোগী হতে হবে। ২০২১ হোক সেই ঘুরে দাঁড়ানোর
সূচনাকাল।
(২৮ ডিসেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলো
পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন