আজ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস‘ পালন করছে আওয়ামী লীগ। যদিও ডিসেম্বর মাসে একটিই বিজয় দিবসের কথা সারা বিশ্ব জানে, যেটি বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসে উপলক্ষ্যে প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান এবং দেশবাসীকে অভিনন্দনও জানিয়ে থাকেন। কিন্তু, গণতন্ত্রের কথিত বিজয় দিবসের কোনো স্বীকৃতির কথা আজ অবধি শুনিনি।
গতবছর আওয়ামী লীগ প্রথম এই দিবসটি পালন করেন। তবে, ৩১ ডিসেম্বরের খবরের
কাগজে গতবছরের ৩০ ডিসেম্বরের যে ছবি দেখা যায়, তা এমন গণতন্ত্র যেখানে বামজোটের কর্মীদের
পুলিশ লাঠিপেটা করছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁদের পেটানো হয়, আহত হন অন্তত ৪৫ জন।
বামজোট ‘গণতন্ত্রের কালো
দিবস‘ পালনের চেষ্টা
করায় তাঁদের এই পরিণতি। আর, বিএনপি যে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস‘ পালন করতে চেয়েছিল, পুলিশ তার অনুমতি দেয়নি, তারা সমাবেশও করতে পারেনি।
ভোটের অধিকার হারানোর পর মতপ্রকাশের অধিকার হারানোকে যদি গণতন্ত্রের বিজয় হিসাবে উদযাপন
করা হয়, ক্ষমতার দাপটে তা হতেই পারে। কিন্তু, এসব আয়োজনে সত্য নাকচ হয়ে যায় না।
দুই বছর আগে নিশিরাতে ভোট সম্পন্ন করার কৃতিত্বের অধিকারী নির্বাচন কমিশন
অবশ্য গত কয়েকদিনে নতুন করে আবার রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর দেশের
৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ এনে তাঁদের
সাংবিধানিক পন্থায় অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন জানিয়েছেন, তাতেই এই পুরোনো
বিতর্ক আবারও কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে ঠিক ৫৩ সপ্তাহ আগে দূর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারদের আশু অপসারণ
ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই‘ উল্লেখ করে বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল। টিআইবি বলেছিল, ‘এই কমিশন দেশকে এক অভূতপূর্ব নির্বাচনের দায় চাপিয়ে দিয়েছেন, যার পরতে পরতে অনিয়মের
অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো তদন্ত হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনাররা এবং
সচিবালয়ের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে জনগণের করের টাকা হরিলুট করেছেন এমন অভিযোগ
উঠেছে। তাঁরা তাঁদের শপথের অবমাননা করছেন, সংবিধান অবমাননা করছেন‘। টিআইবির পরিচালনা পরিষদের তৎকালীন সভাপতি সুলতানা কামাল এবং নির্বাহী পরিচালক, ডঃ ইফতেখারুজ্জামান এবারও অন্য ৪০ জনের
সঙ্গে আবেদনে অংশ নিয়েছেন।
গতবারের টিআইবির বিবৃতির সঙ্গে অবশ্য এবারের বিশিষ্ট
নাগরিকদের আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় পার্থক্যটা বেশ লক্ষ্যণীয়। টিআইবির বিবৃতিটির বিষয়ে তখন নির্বাচন কমিশন কিম্বা সরকার কোনো প্রতিবাদ করেনি। আমরা তাই ধরে নিয়েছিলাম
যে কমিশন এবং সরকারের কাছে এসব গুরুতর অভিযোগের কোনো জবাব নেই বলেই তাঁরা নীরব থেকেছেন।
অবশ্য, বিরোধী দলগুলোও যে ট্রান্সপারেন্সির বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল তা-ও নয়। বিরোধীদলগুলো সম্ভবত দম হারিয়ে ফেলায় এবিষয়ে নীরবতাপালনের বিকল্প কিছু ভাবতে
পারেনি। যেসব গুরুতর অসদাচরণের কারণে তখন টিআইবি কমিশনারদের অপসারণ চেয়েছিল, তার কোনো
সুরাহা ছাড়াই বিরোধীদল বলতে যাদেরকে এখনও গোণায় ধরা হয়, সেই বিএনপি অবশ্য একের পর এক
প্রহসনমূলক নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করে চলেছে। এমনকি তাদের কথিত আইনী লড়াই অজ্ঞাতকারণে
থেমে গেছে। তাদের এই স্বীকৃতিতে সরকার এবং কমিশন কার্যত যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে,
তাতে সন্দেহ করার খুব একটা অবকাশ নেই।
এবার তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ ৪২ জন বিশিষ্ট
নাগরিককে বিএনপি ঘরানার বলে অভিহিত করেছেন। অথচ, স্মরণ করা যেতে পারে এসব বিশিষ্টজনের
মধ্যে এমন একাধিক ব্যাক্তি আছেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা করার জন্য আওয়ামী
লীগের পক্ষ থেকেই যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে
এবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রীতিমতো দাবি করে বসেছেন
যে তাঁর পরিচালিত নিশিভোটকে বিদেশিরাও সুষ্ঠু বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সেখানে অবশ্য
তাঁকে কেউ প্রশ্ন করেনি যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন নির্বাচনটিকে
‘বিশ্বাসযোগ্য‘ হয়নি বলেছে। কিম্বা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর
কেন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা না দেওয়ার অভিযোগ করেছে?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা যে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কথা
বলেছেন, তাঁরা যে পরে নিজেরাই স্বীকার করেছেন তাঁরা আওয়ামী লীগের সাংসদের প্রতিষ্ঠানের
আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন, সেকথাও তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতো। তাঁকে গতবছরের ৮ মার্চের
নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ সভায় তাঁর দেওয়া বক্তৃতার কথাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার
ছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন ‘যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে
ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না‘। আরেকজন কমিশনার শাহাদাত হোসেন আলাদাভাবে ৪২ নাগরিকের বিবৃতির সমালোচনা করে
তাঁদের অভিযোগের পিছনে উদ্দেশ্য খুঁজেছেন। কিন্তু, এই শাহাদাত হোসেনই সেসময়ে বলেছিলেন
যে ‘উপজেলা নির্বাচনে আগের রাতে ভোট চলবে না‘।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন-বিকৃতির পটভূমিতে উপজেলা নির্বাচন
আয়োজনের সময়ে গতবছরের ২ মার্চ বামজোট এক বিবৃতিতে ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকা
অপচয় করে নির্বাচনের নামে তামাশা বন্ধ করার‘ আহ্বান জানিয়ে বলেছিল ‘ভোটের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে‘। দূর্ভাগ্যজনকভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা তো বন্ধ হয়ই নি, বরং জনগণের করের টাকার যথেচ্ছাচার হচ্ছে। এখন কমিশনের সাধ জেগেছে সদলবলে বিশ্বের কয়েক ডজন দেশ সফরের। যেকারণে প্রবাসীদের স্মার্টকার্ড দেওয়ার একটি প্রকল্পও সরকারের অনুমোদন পেয়ে গেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছেন, সেগুলো সরকারি পরিচয়পত্র। তাহলে, অতিরিক্ত আলাদা পরিচয়পত্র কেন দরকার হবে? তাও শুধু ভোটের জন্য, যেখানে দেশের ভেতরে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই সবার ভোট হয়ে যায়?
নির্বাচন কমিশন যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার
দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হয়েছে, তা নিয়ে কারো মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি বা সংশয় নেই। ক্ষমতাসীন
দলের জোটসঙ্গীরা ( যেমন: মরহুম মাঈনুদ্দিন খান বাদল ও রাশেদ খান মেনন) সংসদে এবিষয়ে
যা বলেছেন, তা কার্যবিবরণী খুঁজলে পাওয়া যাবে। আওয়ামী লীগের নেতারাও তা জানেন, তবে
রাজনৈতিক কারণে স্বীকার করেন না। কেননা, এসব অন্যায় তাঁরা মিলেমিশে করেছেন। এবং ২০১৮‘র ডিসেম্বরই প্রথম নয়। এর আগে, ২০১৪‘র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
করেছিল যে রকিব কমিশন তাঁরাও ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছায় বিনাভোটের সংসদ গঠন সম্ভব করেছিল।
সরকার অনিচ্ছুক হলে, কিম্বা এসব নির্বাচনী অনিয়ম-দূর্নীতিতে সহযোগিতা না করলে কোনো
কমিশনের পক্ষেই এককভাবে এতোটা অসদাচরণ সম্ভব নয়। সাংবিধানিক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান,
সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত ও দেশত্যাগের
নজির তো খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়।
এই অবস্থার দায় কি তাহলে শুধুই নির্বাচন কমিশনের? বস্তুত, এই নির্বাচনী দূর্নীতিতে যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁদের দায় নির্ধারণের প্রশ্নটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা প্রয়োজন। বিরোধী দলগুলোর ভূমিকাও এক্ষেত্রে কম হতাশাজনক
নয়। দমন-পীড়নের জন্য তাঁরা হয়তো আন্দোলন করার ক্ষমতা হারিয়েছেন, কিন্তু নির্বাচনী প্রহসনে
দিনের পর দিন অংশ নিয়ে তাঁরা যে কমিশনকে বৈধতা দিয়ে চলেছেন, তার জবাবদিহিতা কোথায়?
নাগরিকসমাজের গুরুত্বর্পূণ কন্ঠগুলো বিষয়টিতে নজর দিতে হয়তো একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছেন,
কিন্তু তাঁরা অন্তত কমিশনের নৈতিক বিচ্যূতির বৈধতার দাবিকে নাকচ করে দিতে পেরেছেন।
রাতেরবেলায় ভোটাধিকার হরণের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে সেজন্যে অন্তত তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
(৩০ ডিসেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন