বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যক্তিটি তাঁর প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীকে এখন যদি মাথাপ্রতি এক লাখ পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ৮৯ লাখ টাকা) করে দেন, তাহলে তাঁর যে অর্থ খরচ হবে, তারপরও তাঁর সম্পদ করোনাকালের আগে যা ছিল তা-ই থাকবে। হিসাবটা আমার নয়। অঙ্কটা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের অধ্যাপক রবার্ট রেইখের, যিনি পুঁজিবাদী বিশ্বের শীর্ষে থাকা দেশটির শ্রমমন্ত্রী ছিলেন।
অধ্যাপক রবার্ট রেইখ গত ২৮ নভেম্বর এক টুইটে এই তথ্যটির সঙ্গে আরও যোগ করেছেন, আমাজন কোম্পানির প্রধান জেফ বেজোস তাঁর কর্মীদের মুনাফার ভাগ দেওয়ার বদলে এমনকি তাঁদের অসুস্থতাজনিত ছুটির সময় বেতনও দিচ্ছেন না। তিনি তাঁর গুদামগুলোতে ২০ হাজার কর্মীকে কোভিডের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করছেন।
করোনাকালের ১০ মাসে আমাজনে আরও ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে বলেও রবার্ট রেইখ তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন। বৈষম্য, অসাম্য বা অসমতা, যে পরিভাষাই আমরা ব্যবহার করি না কেন, করোনাকালে সেই বৈপরীত্যের যে প্রকট ও নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা যাঁদের জন্য এ রকম অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনে দিয়েছে তাঁদের তালিকা নিয়ে খুব একটা লুকোছাপা নেই। জেফ বেজোস ছাড়াও এ রকম আরও যাঁদের ঈর্ষণীয় সম্পদপ্রাপ্তি হয়েছে, তাঁরাও সুপরিচিত ধনী। এঁদের মধ্যে আছেন স্পেসএক্সের এলন মাস্ক, ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, মাইক্রোসফটের বিল গেটস। বলা হচ্ছে, মহামারির শুরুর দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় দীর্ঘ সময়ের লকডাউনে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাজন। ঘরে থাকা মানুষ ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সময় দিয়েছে বেশি। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারাও ফেসবুকেই ঝুঁকেছে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। মধ্যস্বত্বভোগীরাও রমরমা কমিশন ব্যবসা করেছেন, যেগুলোর বিবরণ এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশেও যে এ রকমটি ঘটছে না, তা নয়। পিপিই থেকে শুরু করে টিকার ব্যবসা সবকিছুই হচ্ছে এবং হবে। তবে কতটা স্বচ্ছ ও যৌক্তিকভাবে ঘটছে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে কে আরও কত সম্পদের মালিক হলেন, তা জানা যায় না। নিম্নমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ কিংবা ভুয়া কোভিড টেস্টের মতো জালিয়াতিতে হাতেগোনা কয়েকজন ধরা পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে করোনাকালে বাড়তি ব্যবসার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি।
ব্যবসায়ীরা সবাই যে অন্যায় সুযোগ নিচ্ছেন বা নিয়েছেন এমন ঢালাও কথাও বলা যায় না। তবে করোনার মধ্যেই কালো টাকা সাদা করার খবরে কিছুটা ধন্দ তৈরি হয় বৈকি। খবরে বলা হচ্ছে, ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর দিয়ে যাঁরা কালোটাকা সাদা করেছেন তাঁদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের পরিমাণ চার শ কোটি টাকা। যার মানে দাঁড়াচ্ছে এই ৩ হাজার ৩৫৮ জনের কাছে অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকা ছিল চার হাজার কোটি!
এই হিসাবে বোঝা যায়, অনানুষ্ঠানিক নানা পথে দেশে অপ্রদর্শিত আয়ের প্রবৃদ্ধি কী দুর্বার গতিতে এগোচ্ছে! অবশ্য শুধু কালো টাকার কথাই বা কেন বলি? গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাবে জানা গেল, মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন।
বিপরীতে সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় গরিব আরও গরিব হচ্ছেন এবং গরিবের সংখ্যা বাড়ছে। এটিও বৈশ্বিক প্রবণতা। বেকারত্ব বাড়ছে, মজুরি কমছে। ব্রিটেনে গত সপ্তাহেই অর্থমন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন, দেশটির অর্থনীতি তিন শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের মন্দার মুখে পড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী, যার সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতির পারস্পরিক যোগাযোগ বহুগুণে বেড়েছে, সেই ভারতও অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি। তবে আমাদের সরকারি হিসাবে আমরা এখনো ভালো আছি। অর্থনীতি এখনো বাড়ছে।
বেসরকারি হিসাবে চিত্রটা অবশ্য ততটা সুখকর নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বসাম্প্রতিক বৈশ্বিক মজুরি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এশীয় প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের গড় মজুরি হার অন্য সবার চেয়ে কম। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে যে ন্যূনতম আয়কে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণে ব্যবহার করা হয়, বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি তারও নিচে, মাসে মাত্র ৪৮ ডলার (৪ হাজার ৮০ টাকা)।
আইএলও বলছে, মহামারির কারণে মানুষ আরও বেশি সংখ্যায় কাজ হারানোয় মজুরির পরিমাণ আরও কমছে। দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি গত আগস্টে জানিয়েছিল, লকডাউনের সময় সব শ্রেণির মানুষের আয় কমেছে এবং নতুন একটি দরিদ্র শ্রেণি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতি সচল হলেও তা যে খুব একটা কেটে গেছে এমন নয়। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আরেকটি সংস্থা, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (এফএও) হিসাবে বলা হয়েছিল, দেশে করোনার কারণে আয় কমেছে শতকরা ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের।
করোনা মহামারিতে প্রকট বৈষম্যের এই যে ছবি, তা লাঘব করা সহজ নয়। কিন্তু কমানোর চেষ্টায় আন্তরিকতা আছে কি? অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা কোথায়? সরকার নানা ধরনের নীতি ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিয়ে এই কাজটি করবেন বলে যাঁরা আশা করেছিলেন, তাঁরা অনেকাংশেই হতাশ হয়েছেন। সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা ও সহায়তা কার্যক্রমের যেসব হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে সব সময়ে যাঁরা সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত, তাঁরাই বেশি সুবিধা পেয়েছেন। বিপরীতে যাঁদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি বা যাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল কম এবং সাহায্যও পৌঁছেছে কম।
আমার বন্ধুস্থানীয় জাহাঙ্গীর কবীরের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস, যাকে করোনাকালের দিনলিপি বলাই সংগত হবে, আলো প্রেম নির্জনতা পড়ার সময়েও এই একই চিত্রের প্রতিফলন খুঁজে পেলাম। ঢাকা এবং মফস্বলের শহর মাগুরার চালচিত্রেও দেখি সাধারণ শ্রমজীবী যখন কর্মহীন অনিশ্চয়তার যন্ত্রণায় মুক্তির পথ খুঁজছেন, তখন একটি পশ্চাৎপদ ও কৃষিপ্রধান জনপদের ব্যাংকার ব্যাংকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টাকা জমা পড়ার কথা জানাচ্ছেন। করোনা শহুরে রোগ, গ্রামে কারও কিছু হবে না—এই যে মনোভাব, তার পেছনেও রয়েছে অর্থনীতি এবং তা বৈষম্যের।
মহামারি যে শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিংবা নির্মূল হবে এমন দাবি কোনো অতি-আশাবাদীর মুখেও শোনা যায় না। রোগ মোকাবিলায় তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেই সবার সর্বোচ্চ মনোযোগ। অথচ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যক কাজটি, অর্থাৎ রোগ শনাক্তকরণেও দেখা গেল সরকারের নীতি বৈষম্যমূলক। প্রথমে শনাক্তকরণ পরীক্ষা সবার জন্য বিনা মূল্যে রাখা হলেও তা এতটাই সীমিত ছিল যে কথিত প্রভাবশালীদের প্রভাব ছাড়া সাধারণ কারও পক্ষে এই পরীক্ষার সুযোগ মেলা কঠিন ছিল। পরে যখন এই শনাক্তকরণ পরীক্ষার পরিধি বাড়ানো হয়েছে, তখনই জুড়ে দেওয়া হয়েছে ফি। শনাক্তকরণ পরীক্ষার মত টিকার
ওপরও হঠাৎ করেই ফি আরোপের আশঙ্কা কি নাকচ করে দেওয়া যায়?
গত সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভিড ১৯ এর তিন কোটি ডোজ টিকা সরকার কিনবে এবং বিন্যামূল্যে তা মানুষকে দেওয়া হবে। এর বাইরে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য টিকার ব্যবস্থা করার যে চেষ্টা চলছে, সেই গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের আওতায় বাংলাদেশের আশা আরও ছয় কোটি টিকা। তারপরও টিকার বাইরে অনেকেরই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই টিকার ক্ষেত্রে বৈষম্যের আরেকটি বৈশ্বিক নজির হচ্ছে ফাইজারের টিকা। ব্রিটেনে আগামী সপ্তাহেই এই টিকার প্রয়োগ শুরু হবে। আর আমেরিকায় সম্ভবত চলতি মাসের মাঝামাঝি। উন্নত বিশ্বের এই দুটি দেশে ফাইজারের টিকাই এখন আশার আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু এই টিকার রক্ষণাবেক্ষণে যে বিশেষায়িত তাপমাত্রার প্রয়োজন তার উপযোগী অবকাঠামোর ব্যবস্থা করা দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এটিও করোনাকালের আরও একটি পরিহাস।
(৭ ডিসেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন