সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অবসরের পর দায়মুক্তির প্রস্তাবের উৎস কী

‘অবসরের পর দোষী সাব্যস্ত হলে পেনশন বাতিল‘ শিরোনামের খবরটি দেখে খটকা লেগেছিল। শিরোনামটি ছিল গেল সপ্তাহের মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের সিদ্ধান্তের খবরের। খবরে বলা হয়েছে, অবসরে থাকা সরকারি কর্মচারীরা অপরাধী হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে তাঁদের পেনশন সুবিধা বাতিল, স্থগিত বা প্রত্যাহারের বিধান রহিতের প্রস্তাব করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) আইন, ২০২১’–এর খসড়া গত সোমবার মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হলেও সেটির অনুমোদন হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব করেছিল। এর ফলে আইনের বিদ্যমান বিধানটিই বহাল থাকল। 

শিরোনামটির বিভ্রান্তিতে ধারণা হতে পারে সরকার একটা নতুন এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবরটি বলছে আইনে আছে অবসরের পর দোষী সাব্যস্ত হলে পেনশন বাতিল, স্থগিত বা রহিতের বিধান আছে এবং সেটি বাতিলের প্রস্তাব করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভা প্রস্তাবটি অনুমোদন করে নি। সরকারি আমলা-কর্মচারিদের তুষ্ট করতে সরকার গত কয়েকবছর ধরে ধারাবাহিকভাবে যেসব বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে, তাতে এই প্রস্তাবটা নাকচ হওয়ার সিদ্ধান্ত যে একটি ব্যাতিক্রম, তা মানতেই হয়।

 

এরকম একটি অবিশ্বাস্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জন্য সরকারকে অবশ্য ধন্যবাদ দেওয়া যাচ্ছে না। কেননা, সরকারের অতীব গুরুত্বর্পূণ একটি মন্ত্রণালয় এই অনৈতিক প্রস্তাবের প্রস্তাবক। এধরণের অনৈতিক ও অন্যায় প্রস্তাব যাঁরা তৈরি করেছেন এবং মন্ত্রীসভার বৈঠকে উত্থাপনের জন্য খসড়া তৈরি ও উত্থাপন করেছেন, তাঁদের দায় নির্ধারণ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরই সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ প্রশ্ন হলো, মন্ত্রণালয় এধরণের দায়মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো কেন?

 

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের নিবন্ধের (প্রথম আলো, ১ জুলাই, ২০২১)  শিরোনাম ধার করে নিয়ে যদি বলা হয় যে, আমাদের লোক হওয়ার সুফল আমলারা বুঝে গেছেন, তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। তিনি লিখেছেন, (প্রশাসনের) একটি অংশ নিজ থেকেই সরকারদলীয় লোকের মতো আচরণ করছে। ২০১৮-এ নির্বাচনটিতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার গেছেন কজন প্রশ্ন তুলে তিনি আরও লিখেছেন, ভোট তো পড়েছে লাখ লাখ। সে ভোট কে বা কারা দিয়েছেন, কারা করেছে নিয়ন্ত্রণ - এটা আর অজানা বিষয় নয়। --- কিন্তু সে নির্বাচনগুলোর সঙ্গে জনগণের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু, তা তো সবাই জানেন। এর ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আনুগত্য কিছুটা শিথিল হয়েছে বলে ধরা যায়। এটা অভিপ্রেত না হলেও অনিবার্য।


এই সুফল আদায়ের প্রশ্নটির আরও কিছু তাৎপর্য আছে কি না, তা বোঝার জন্য কয়েকটি তথ্য এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক।সরকারি কেনাকাটা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে যে সব অবিশ্বাস্য দূর্নীতির খবর মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পায়, তা সে পারমাণবিক বালিশ কিম্বা ঢালাইয়ের কাজে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার - এগুলোতে অঘোষিত সম্পদ বাড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের। দায়মুক্তির নিশ্চয়তা না মেলা পর্যন্ত দূর্নীতির আয়ে একধরণের অস্থিরতায় ভোগা খুবই স্বাভাবিক। 

 

গত বছর ১৮ নভেম্বর ঢাকায় সাংবাদিকদের সংগঠন, ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন আমাদের জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। তবে যে তথ্য তাঁরা পেয়েছেন, তাতে তাঁরা দেখেছেন যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা কানাডায় সপরিবারে অবসর কাটালেও বাৎসরিক ভ্রমণে দেশে ফিরলে সেই খরচ মেটানোর জন্য পেনশনের টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। অবসরের পর দায়মুক্তিই কেবল সেটি নিশ্চিত করতে পারে।

 

করোনা মহামারির সময়ে সরকারি চাকরিতে থাকার পাশাপাশি ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার একাধিক ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেই এমন ধারণার জন্ম হয় যে এঁরা অনেকেই বেনামে ব্যবসা করছেন। ‘সরকারি চাকরিজীবিরা ব্যবসায় জড়াচ্ছেন‘ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে আরিফুর রহমান প্রথম আলোতেই লিখেছেন: সরকারি কর্মকর্তারা কী ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তা জানতে এই প্রতিবেদকের কথা হয় প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কোম্পানির পরিচালক পদে যুক্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি পদে থেকে তাঁরা অন্য প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন।

 

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে সরকারের অনুমোদন ছাড়া তাঁরা মালিক বনে যাচ্ছেন। অনেকে গাড়ি কিনে সে গাড়ি ভাড়ায় দিচ্ছেন। কেউ কেউ জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হচ্ছেন। কেউ কেউ ফার্ম করে পেছনে থেকে সরকারি দপ্তরের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন।গত এপ্রিলের ওই প্রতিবেদনে জানা যায় যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবসায় জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে । সর্বসাম্প্রতিক খবর হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা - কর্মচারিদের সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধি পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য সব মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধি সবাই নীতিনিষ্ঠভাবে মান্য করবেন এতোটা আশাবাদী আমরা কেউই নই। তবে তা যদি কিছুটা হলেও কার্যকর হয়, তাহলে বড় বড় পদধারীদের কেউ কেউ যে বিপদে পড়বেন, সেটা অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না।

 

এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি চাকরি পেয়েছেন বা পদোন্নতির সুবিধা নেওয়ার মত অপরাধও তো সবার জানা। এরকম অন্যায় সুবিধাভোগীর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান যদিও পাওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন যে সাংবাদিক, সেই রোজিনা ইসলামের ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে তখন অবধি ১৫১ জনের সনদ বাতিল করা হয়েছিল। অন্তত চারজন সচিবের ভূয়া সনদ দিয়ে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পদোন্নতির সুবিধা নেওযারও প্রমাণিত অপরাধ। সরকারি চাকরিবিধি এবং ফৌজদারি আইন অনুসরণ করা হলে তাঁদের সবারই শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু কারও সাজা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। ওই সচিবদেরও দুএকজন বিদেশে অবসর যাপন করছেন।

 

বাংলায় পাবলিক সার্ভিস মানে সরকারি চাকরি বা জনসেবা এবং পাবলিক সার্ভেন্ট বলতে সরকারি কর্মচারি বোঝানোর যে ধারা চালু ছিল তার পরিশীলন ঘটেছে পরিভাষায় যখন থেকে জন প্রশাসন এবং জন প্রশাসনের কর্মকর্তা বিশেষণগুলো চালু হয়েছে ২০১১ সালে মন্ত্রণালয়ের নাম বদলের পর থেকে।  অতপর জনসেবকদের কেউ কেউ নিজেদের প্রশাসক গণ্য করে অতিক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন। এই ক্ষমতার উৎস অবশ্য অনেকটাই নিহিত আছে সরকারি কর্মচারি আইন ২০১৮-তে দেওয়া বিশেষ সুরক্ষার বিধানগুলোতে। আইনটির ৪১(১) ধারায় সরকারি কর্মচারিকে ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করতে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।

 

আইনটি সংবিধানের সব নাগরিকের সমঅধিকারের বিধানের পরিপন্থী হিসাবে কেন অবৈধ ঘোষণা এবং বাতিল করা হবে না, সেই মর্মে হাইকোর্টের জারি করা কারণ দর্শানোর নোটিশ এখনও অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। আইনগতভাবে দায়মুক্তি ভোগের এই সুবিধা যে আমলাদের কাউকে কাউকে বেপরোয়া করে তুলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তাই অবসরোত্তর দায়মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানই যথেষ্ট নয়। প্রস্তাবকারীদের জবাবদিহি প্রয়োজন এবং বিদ্যমান আইনে যে অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা-ও বাতিল করা জরুরি।


(২ অগাস্ট, ২০২১-‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...