আফগানিস্তানে রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তায় আর্ন্তজাতিক সমর্থনপুষ্ট সরকারের পতন ও তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে উঠছে কোন ছবি - এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। কাবুলে আমেরিকানদের নিজ দূতাবাস থেকে বিমানবন্দরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক হেলিকপ্টারের চক্কর দেওয়ার ছবি , নাকি স্বদেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানদের আমেরিকান সামরিক পরিবহন বিমানে ওঠার জন্য দলে দলে দৌড়ানোর দৃশ্য? প্রথম ছবিটি ৪৫ বছর আগে সায়গন ছেড়ে আসার দৃশ্যের প্রায় অবিকল পুর্নমঞ্চায়ন। দেশে দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের আগ্রাসী নীতির ব্যর্থতার এই স্মারক দৃশ্য প্রায় ২৪ ঘন্টা ধরে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু পরদিন থেকে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রধান ছবি হয়ে যায় দেশ ছাড়তে বেপরোয়া আফগানরা। নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্য নিন্দিত তালেবানের সম্ভাব্য প্রতিশোধ ও নিপীড়ন থেকে জীবন বাঁচানোর তাড়না আফগানদের মধ্যে কতটা প্রবল, তার প্রতীক হিসাবেই এ ছবিটি এখন ঘুরেফিরে সংবাদে উঠে আসছে।
তালেবানের এই ভাবমূর্তির ভিত্তি হচ্ছে তার অতীত শাসনকাল। শরিয়াহ
আইনের কঠোর প্রয়োগ ও নারীর অধিকারহরণের রেকর্ড তালেবান শাসন সম্পর্কে উদ্বেগ ও আতঙ্কের
কারণ। আর্ন্তজাতিক পরিসরে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় আপাতত তালেবান
যে কিছুটা সংযমী হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় নারীশিক্ষা এবং তাদের কাজ
করার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তারা বলেছে ইসলামসম্মতভাবে তাঁরা এগুলো করতে পারবেন। কাবুলে
তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রথম প্রশ্নটিও করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে একজন নারী
সাংবাদিককে, যদিও তিনি বিদেশি।সরকারি কর্মচারি এবং যারা বিদেশি আগ্রাসী বাহিনীকে সহায়তা
করেছে, তাদের প্রতিও সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব অঙ্গীকার সবাইকে বিশ্বাস
করানো সহজ হবে না।
তালেবানের বিস্ময়কর সাফল্য, বিশেষ করে প্রায় বিনা রক্তপাতে ও অত্যন্ত
ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রায় পুরো আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে শুধু ইউরোপ-আমেরিকা
নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাজধানীতেই সরকারগুলো বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কথিত সন্ত্রাসবিরোধী
লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট নেটো আনুষ্ঠানিকভাবেই স্বীকার
করে নিয়েছে যে এত দ্রুত তাঁদের সমর্থনপুষ্ট গনি সরকারের পতন ঘটবে, তা তারা বুঝতে পারেনি।তাদের
আরও বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে তাদেরই গড়া, তাদেরই অস্ত্রে সজ্জিত তিন লাখ সদস্যের সেনাবাহিনীর
কোনো বুলেট খরচ না করেই আত্মসমর্পণ।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সেনা প্রত্যাহারের কথা বলে আসছে ২০১৪
সাল থেকে। তার জন্য একটি রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টাও চলছিল অনেকদিন ধরে। তালেবানের রাজনৈতিক
দপ্তরের প্রধান মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারের সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক
বৈঠকের প্রতীকী গুরুত্ব নিয়ে তেমন একটা বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু তারও আগে গতবছরই
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে মোল্লা বারাদারের যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানেই সেনা
প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক আলোচনার প্রশ্নে সমঝোতা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মাইক পম্পেওর
রিপাবলিকান পার্টি ও তাঁর সহকর্মীরা এই সেনাপ্রত্যাহারজনিত সংকটের দায় পুরোটাই প্রেসিডেন্ট
বাইডেনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন।তালেবানের সঙ্গে এই সমঝোতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের
মধ্যেও যে অস্বস্তি ও ভিন্নমত রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট।
তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানের ভবিষ্যত ও তালেবানের
সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকা মতভিন্নতা।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনা; অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের সমান্তরাল
উদ্যোগ। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে এই মতভিন্নতা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তার প্রতিদ্বন্দ্বী
আঞ্চলিক শক্তি ভারত।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের এই নাটকীয় ব্যর্থতা
যে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল, তা নয়। এমন সম্ভাবনার কথা অনেক গবেষক-বিশ্লেষক অনেকদিন
ধরেই বলে আসছেন।এমনকি নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র
ওসামা বিন লাদেনকে তাদের কাছে হস্তান্তরের দাবি পূরণ না হওয়ায় যখন সামরিক অভিযানের
সিদ্ধান্ত নেই, তখনও অনেকে সেই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। অনেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের
সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কথিত সন্ত্রাসবিরোধী
লড়াই থেকে পিছপা হয়নি। সামরিক অভিযানের ব্যর্থতার ইঙ্গিত যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে
স্কটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের কথা না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারির মধ্যেই
২০০৯-১০ সালে তিনি একাধিকবার আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল সরেজমিন সফর করে তথ্য সংগ্রহ
করেছেন এবং তাঁর গবেষণাপ্রসূত বই ‘রির্টান অব
এ কিং দ্য ব্যাটেল ফর আফগানিস্তান‘- প্রকাশিত
হয় ২০১২ সালে। ওই বইতে তিনি লিখেছেন তাঁর সফরের সময়ে তিনি দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের
নেতৃত্বাধীন আইএসএএফ এর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে ( ন্যাটোবাহিনী পরে
এই আইএসএএফ-এর স্থলাভিষিক্ত হয়)।তখন ১২১টি জেলার মধ্যে মাত্র ২৯টি প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের
নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং ৭০ শতাংশ অঞ্চলে তালেবানের দাপট বজায় ছিল।
উইলিয়াম ডালরিম্পলের বইয়ের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানে ১৮৩৯ সালের প্রথম
ব্রিটিশ অভিযানের সঙ্গে ২০০১ এর অভিযানের তুলনা। ১৮৩৯-এর অভিযান ছিল ভারত থেকে পরিচালিত
ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীর অভিযান, যার মাধ্যমে শাহ সুজা আফগানিস্তানের সিংহাসনে আসীন
হয়েছিলেন। সেবার ব্রিটিশদের পরাজয় ঘটে ১৮৪২ সালে।ডালরিম্পল জালালাবাদে কারজাই মন্ত্রীসভার
সদস্য আনওয়ার খান জাগদলাকের সঙ্গে তাঁর গ্রাম গন্ডামাকে গিয়েছিলেন। গন্ডামাক ছিল ব্রিটিশ
সৈন্যদের শেষ প্রতিরোধের জায়গা। ১৮৪২ সালের ১০ জানুয়ারি সেখানে ২০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য
ঘিলজাই উপজাতির হাজার হাজার সদস্যের হাতে ঘেরাও হলে অল্প কজনই প্রাণে বাঁচতে পেরেছিল।
ডালরিম্পলের পূর্বসুরিদের একজন কলিন ম্যাকেঞ্জিকেও সেখানে জিম্মি করা হয়েছিল।সেই যুদ্ধ
এবং তার পরের বিদেশী আগ্রাসনগুলোর সব ইতিহাসই স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে আছে। জাগদলাক
নিজেও ঘিলজাই গোত্রের একজন। গ্রামটি ঘুরে দেখা শেষ হওয়ার পর জাগদলাকের কাছে ডালরিম্পল
জানতে চাইলেন ১৮৪২ এর সঙ্গে ২০০৬ এর কোনো মিল আছে কিনা? উত্তর ছিল, ‘এটা একেবারে
এক। তখনও বিদেশিরা এসেছিল নিজেদের স্বার্থে, আমাদের জন্য নয়; এবারও তাই। ওরা বলে, আমরা
তোমাদের বন্ধু, আমরা সাহায্য করতে চাই। কিন্তু ওরা মিথ্যে বলছিল‘।
পরদিন ডালরিম্পল ঘিলজাই উপজাতির প্রবীণদের পরিষদ বা জিরগায় উপস্থিত
হন। আগের দিন তালেবানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সংঘাতের বিষয়ে আপস আলোচনাই ছিল ওই জিরগার উদ্দেশ্য।
সেখানেও তিনি কারজাই সরকারের দূর্নীতি, অযোগ্যতা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতির
অভাব নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ শুনতে পান, যা এর আগে অন্যান্য জায়গাতেও শুনেছেন। ডালরিম্পল
লিখেছিলেন, এসব ক্ষোভই তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পথ করে দিচ্ছে। জিরগায় অংশ নেওয়া দুজন
প্রবীণ তাঁকে বলেছেন যে আমেরিকান অফিসাররা তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিল ‘আপনারা কেন
আমাদের ঘৃণা করেন‘? তাঁদের একজন উত্তর দিয়েছিলেন ‘তোমরা আমাদের
ঘরের দরজা ভেঙ্গে বাসায় ঢুকে মেয়েদের চুল ধরে টানো, বাচ্চাদের লাথি মারো। আমরা এটা
মানতে পারি না। আমরা জবাব দেব, দাঁত ভেঙ্গে দেব। ব্রিটিশরা তোমাদের আগে যেভাবে চলে
গেছে, তোমরাও সেভাবে চলে যাবে‘। তাঁরা বলেছিলেন, ‘সত্য হচ্ছে
সব আমেরিকানই জানে যে খেলা শেষ। শুধু রাজনীতিকেরা তা অস্বীকার করে। আমেরিকানদের সময়
ঘনিয়ে এসেছে। এরপর হচ্ছে চীন‘।
১০ বছর আগে ডালরিম্পলের লেখায় যেসব কথা উঠে এসেছে, তারপর কি তালেবানের
ক্ষমতায় ফিরে আসাকে হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিস্ময় বলা যাবে? বরং যুক্তরাষ্ট্রের টিভিতে যাঁরা
মধ্যরাতের কৌতুক অনুষ্ঠান করেন, তাঁরাই এর ভালো সারর্মম টেনেছেন। রাজনীতিকদের হুলফোটানো
তাঁদের কৌতুকগুলোর ওপর তৈরি প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে নিউইয়র্ক টাইমস ‘দ্য রাইট
থিং ফিলস সো রং‘ (ঠিক জিনিসকে এতো ভুল মনে হয়)। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও
তো স্বীকার করেছেন আফগানিস্তানে তাঁর সেনাবাহিনী আরও অনেক বছর থাকলেও সেখানে আর কিছু
করতে পারতেন না। আর বাকি বিশ্বের ডান-বাম সব মতের লোকই তো বিদেশী আগ্রাসনের অবসান চেয়ে
এসেছেন।
(১৯ আগস্ট, ২০২১-‘র প্রথম আলো
পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন